মানুষের জীবনে কখনো কখনো কোনো ব্যক্তি আজীবন স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে থাকে। চলার পথে তার স্মৃতি হাতড়ে শুধু অনুপ্রেরণাই পাওয়া যায়। আজ যে মানুষটিকে নিয়ে কথা বলবো- তিনি আমাদের খোকসা উপজেলার জানিপুর (একতারপুর) ইউনিয়নের স্বর্গীয় শিবনাথ ঘোষের পুত্র শিশির কুমার ঘোষ। ছোটবেলা থেকেই স্কুলজীবনে দ্বিতীয় হওয়ার গৌরব মেলেনি তার। পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে তিন সেকশনে ১০০ জনের মধ্যে প্রথম হয়ে সপ্তম শ্রেণিতে উন্নীত হোন। তারপর আর কখনো পেছনে তাকাতে হয়নি।
শিক্ষাজীবনে সবসময় তিনি প্রথম গ্রেডে বৃত্তি পেয়েছেন। ১৯৭১ সালে এসএসসি পরিক্ষার্থী হলেও স্বাধীনতা আন্দোলনের কারণে ১৯৭২ এর মার্চে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে এটিই ছিল এসএসসির (তৎকালীন মেট্রিকুলেশন) প্রথম ব্যাচ। শিশির কুমার ঘোষ কুষ্টিয়া জেলা স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করার পরে কুষ্টিয়া পলিটেকনিক্যালে ৮০০ প্রার্থীর মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করে ১৯৭২ সালে কুষ্টিয়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। তারপর কৃতিত্বের সাথে সবসময় কলেজে প্রথম হয়ে ১৯৭৫ সালে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং (সিভিল) পাশ করেন।
পেশাজীবনের প্রারম্ভে একসাথে তিনটি চাকরির প্রস্তাব ছিলে। প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা,পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ও কেয়ার বাংলাদেশের কর্মকর্তা। ১৯৭৬ সালে অবশেষে তিনি প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা হিসেবে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। সফলতার সাক্ষর রাখেন কর্মস্থলেও। কয়েকবছরেই পদোন্নতি পান তিনি। প্রথমে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা, তারপর দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ঢাকা মহাপরিচালকের কার্যালয়ের উপপরিচালক। দীর্ঘ সফলতার পর ২০১৫ সালের ১৩ জানুয়ারি ইতি টানেন চাকরিজীবনের।
অস্বচ্ছল পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষটির কাঁধে সংসারের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল বলতে গেলে ছাত্রজীবন থেকেই। সাত ভাই বোনের সংসারে ভাইদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবার বড়। ১৯৭৫ সালে বাবা মারা যাওয়ার পরে শুধু সংসারের হালই ধরেননি, পাঁচটি বোনকে লেখাপড়া শিখিয়ে সুপাত্রস্থও করেছেন তিনি। সেই সুবাদে বোনদের সন্তানেরা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ-বিদেশে তারা আজ প্রতিষ্ঠিত। তারই আদর্শে প্রাণিত হয়ে পরিবারে অন্য সদস্যদের এই অবস্থান।
সমাজসেবামূলক কাজেও তিনি নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। চাকরিজীবনে এলাকার মানুষের জন্য সাধ্যমতো সহযোগিতা করেছেন। তার নিজ এলাকার স্কুলে ঈশ্বরদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন টানা পাঁচ বছর। ১৯৯৯ সালে তার কষ্টার্জিত সঞ্চিত ডিপিএস ভাঙানোর পুরো টাকা দিয়েই করেছেন স্কুলটির অবকাঠামো উন্নয়ন। কী বড় মন তাঁর, কত মহান তিনি!
তার দুই ছেলে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার। এক ছেলেবউ ফার্মাসিটি বিষয়ে শেষ করেছেন অনার্স ও মাস্টার্স)। বর্তমান তিনি ছেলে-বউমা ও নাতিছেলেকে নিয়ে সস্ত্রীক ঢাকা খিলক্ষেতে অবস্থান করছেন।
স্বপরিবারে বাবু শিশির কুমার ঘোষ (ছবি : সংগৃহীত)
এই গুণী মানুষটি আমার প্রয়াত বড় ভাই ইঞ্জিনিয়ার শহিদুল আলম চুন্নুর বাল্যবন্ধু। ছোটবেলায় ঝাপসা কিছু স্মৃতি মনে পড়ে। দাদাকে আমার ভাইয়ের সাথে মাঝে মধ্যে আমাদের বাড়িতেও দেখেছি, তবে খুবই অস্পষ্ট। দাদার একটি বিষয় শুধু আমার মনের মনিকোঠায় এখনো জায়গা দখল করে। সেটি হলো দাদার অভিনয় নৈপুণ্যতা। সে সময়ে নারী চরিত্রে অভিনয় করার জন্য কোন নারী শিল্পী পাওয়া যেত না। সে কারণে সুদর্শন ছেলেকেই বেছে নেওয়া হতো নারী চরিত্রের জন্য। ঐ নারী চরিত্রে দাদাই ছিলেন মুশকিলের একমাত্র আসান।
আমার স্পষ্ট মনে আছে দিয়ানত স্যারের পরিচালনায় সাগর সেঁচা মানিক নাটকে মুক্তা চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকের প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। দাদার বিপরীতে নায়কের অভিনয় করেছিলেন দাদারই ক্লাসমেট আব্দুস সালাম।
এসব ঘটনা ১৯৭২ সালের। তখন আমার বয়স ১০ কী ১১ বছর। স্মৃতিতে মাঝে মাঝে ধরা দেয় আবার হারিয়ে যায়। দাদার কলেজ লাইফে আবার যাত্রামঞ্চে নায়ক চরিত্রেও দেখেছি। তারপর থেকে দাদার সাথে আর যোগাযোগ ছিল না। ফেসবুকের কল্যাণে অল্প কিছুদিন হলো দাদাকে খুঁজে পেয়েছি। তবে পরিচয় দিতে হয়েছে- আমি চুন্নুর ভাই। পরিচয় পেয়ে দাদার অনুভূতি এবং আন্তরিকতা ছিল এমনি- মোবাইল ছেদ করে আমাকে জড়িয়ে ধরা।
অনেক স্মৃতি রোমহ্ণন করলেন আমার সাথে। একে একে অনেক ক্লাসমেটদের কথা বললেন। তাদের মধ্যে অন্যতম কয়েকজনের নাম এবং তাদের মেধা নিয়েও আলোকপাত করলেন। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আমার মরহুম ভাই শহিদুল আলম চুন্নুর কথা বলতে গিয়েই দাদার কণ্ঠ আড়ষ্ট হয়ে গেল। কিছুক্ষণের জন্য দু’জনই নিঃস্তব্ধ, শুধু ভারী দীর্ঘশ্বাসটা যেন বাতাসে উড়ছিল। এই সজ্জন মানুষটি আমার দেখা অন্যতম একজন সফল ও সুখী মানুষ।
লেখক : উপদেষ্টা সম্পাদক, কুষ্টিয়ার সময় ও মহাসচিব, খোকসা উপজেলা কল্যাণ সমিতি-ঢাকা।