কুষ্টিয়ার দৌলতপুর কলেজের অধ্যক্ষ মো. ছাদিকুজ্জামান খান সুমনের অবৈধ নিয়োগ ও বেতন বাণিজ্য চলমান রয়েছে। দৌলতপুর কলেজে নিয়োগ পাওয়া অনার্স শাখার শিক্ষকদের তৃতীয় ও দ্বিতীয় শিক্ষক নিয়োগ দেখিয়ে অবৈধ পন্থায় বেতন করে হাতিয়ে নিয়েছেন ৫ কোটি টাকারও বেশী। এছাড়াও বিভিন্ন বিভাগে অনার্স ও মাষ্টার্স শাখার শিক্ষক এবং কর্মচারী নিয়োগ, কলেজ সরকারী করার নামে শিক্ষকদের কাছ থেকে জোরপূর্বক অর্থ আদায়, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় সহ নানা অনিয়ম ও দূর্নীতি করে বিপুল অংকের অর্থ হাতানোর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। দেখার কেউ না থাকায় এমন অবৈধ কর্মকান্ড অবাঁধে ও নির্বিগ্নে চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি সহজেই। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি সচেতন মহল ও ভূক্তভোগী কলেজের এক প্রদর্শকের ।
দৌলতপুর কলেজের অধ্যক্ষ মো. ছাদিকুজ্জামান খান সুমনের অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্যে দৌলতপুরের সর্বত্র এখন টক অব দা দৌলতপুরে পরিণত হয়েছে। অধ্যক্ষ ছাদিকুজ্জামান খান সুমন দৌলতপুর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হওয়ার সুবাদে এবং সাবেক এমপি সরওয়ার জাহান বাদশাহর আস্থাভাজন হওয়ায় অবাঁধে ও নির্বিগ্নে অবৈধ নিয়োগ ও বেতন বাণিজ্যের রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। কলেজের কেউ বা কোন শিক্ষক এমন অনিয়মের প্রতিবাদ করলে ও জানতে চাইলে তার কপালে নেমে আসে খড়গ। তাকে শোকজ সহ বিভিন্নভাবে নাজেহাল ও হত্যার হুমকি দিয়ে থাকেন এই আওয়ামী লীগ নেতা সুমন।
দৌলতপুর কলেজের ভূগোল বিভাগের প্রদর্শক মো. জহুরুল আলম অধ্যক্ষ ছাদিকুজ্জামান খান সুমনের অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্য ও তার দুর্নীতির তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলে ধরলে তা ভাইরাল হয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে দৌলতপুর কলেজের অধ্যক্ষ ছাদিকুজ্জামান খান সুমন প্রদর্শক জহুরুল আলমের বিরুদ্ধে বিধি বর্হিভূতভাবে নানা পদক্ষেপ নেওয়ারও হুমকি দিয়েছেন। এমনকি তাকে প্রাণনাশেরও হুমকি দিয়েছেন।
এরআগে অধ্যক্ষ ছাদিকুজ্জামান খান সুমনের অবৈধ কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করায় জহুরুল আলমকে অফিস কক্ষে ডেকে নিয়ে তাকে পিস্তুল বের করে প্রকাশ্যে গুলি করতেও উদ্যত হন তিনি। পিস্তুল লক থাকায় গুলি বের না হওয়া সেদিন প্রানে বেঁচে যান জহুরুল আলম।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জহুরুল আলমের দেওয়া পোষ্ট ও তার দেওয়া তথ্য সূত্রে জানাগেছে, দৌলতপুর কলেজের বিভিন্ন বিভাগে অনার্স শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ নেওয়া ১২ জন ও জাল নিবন্ধন সনদে তৃতীয় শিক্ষক হিসেবে ১ জন সহ মোট ১৩ জনকে প্যাটার্ন বর্হিভূতভাবে ডিগ্রি পর্যায়ে তৃতীয় ও দ্বিতীয় শিক্ষক হিসেবে ভুয়া নিয়োগ দেখিয়ে ২০২৩ সালে প্রায় আড়াই কোটি টাকার নিয়োগ ও বেতন বানিজ্য করেছেন অধ্যক্ষ মো. ছাদিকুজ্জামান খান সুমন।
অনার্স শাখায় নিয়োগ পাওয়া ওইসব শিক্ষকদের তথ্য গোপন করে দৌলতপুর কলেজের সাবেক অধ্যক্ষের স্বাক্ষর জাল ও স্ক্যান করে অনলাইনে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ভুয়া তথ্য প্রেরণ করে তাদের ডিগ্রি পর্যায়ে তৃতীয় ও দ্বিতীয় শিক্ষকের বেতন করানো হয়। সরেজমিনে তদন্ত করলে এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ওইসব শিক্ষকদের অনার্স শাখার তালিকা দেখলেই আসল রহস্য উদঘাটিত হবে। এছাড়াও চলতি বছরের এপ্রিল-মে মাসে বিভিন্ন বিভাগে শুন্য হওয়া তৃতীয় শিক্ষক পদে অনার্স শাখায় নিয়োগ পাওয়া আরো ৭ জন শিক্ষককে তৃতীয় শিক্ষক হিসেবে অবৈধ ও ভুয়া নিয়োগ দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে জনপ্রতি ২০ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন অধ্যক্ষ ছাদিকুজ্জামান খান সুমন। অনার্স শাখার ওই ৭ জন শিক্ষকের কাছ থেকে তৃতীয় শিক্ষক হিসেবে বেতন করানো বাবদ ১ কোটি ৪৪ লক্ষ টাকার নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন তিনি।
কলেজে তৃতীয় শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালা ও শর্তাবলী না মেনে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে ম্যানেজ করে কলেজ ছুটি থাকাকালীন সময়ে তিনি এসব অবৈধ নিয়োগ ও অর্থবাণিজ্য করেছেন। অনার্স শাখায় নিয়োগ পাওয়া যে সকল শিক্ষকদের অবৈধ ও জাল স্বাক্ষরে ভুয়া নিয়োগ দেখিয়ে ৪ কোটি টাকারও বেশী নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ইতিহাস বিভাগের কবিরুল ইসলাম। ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জাকির হোসেনের মৃত্যুর পর তার স্থলে স্থলাভিসিক্ত করে অবৈধ পন্থায় প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা নিয়ে কবিরুল ইসলামের বেতন করিয়েছেন অধ্যক্ষ সুমন।
এছাড়াও হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের আবুল কালাম আজাদ ও তরুন হোসেন লাল্টু, ইসলামের ইতিহাস সংস্কৃতি বিষয়ে মির্জা আসলাম, মমিনুল ইসলাম, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের কে এইচ এম ইকবাল (হাবিব), জীব বিজ্ঞান বিভাগের মিজানুর রহমান জুয়েল, ভূগোল বিভাগের শাহাজুল ইসলাম, গণিত বিভাগের আরিফুর রহমান, অর্থনীতি বিভাগের সাহেব আলী, সহকারী লাইব্রেরিয়ান মোমেনুর রহমান মোহন, বাংলা বিভাগের ফারজানা ববি লিনা এবং ইংরেজি বিভাগে জাল নিবন্ধন সনদে তৃতীয় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ নেওয়া রাশেদুজ্জামান রাসেল। এছাড়াও সদ্য অবৈধ নিয়োগ ও বেতন বাণিজ্যের তালিকায় যাদের নাম তৃতীয় শিক্ষক হিসেবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রেরণ করা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন, অর্থনীতি বিভাগের গোলাম মোর্শেদ, ব্যবস্থানা বিভাগের রঞ্জু আহমেদ, বাংলা বিভাগের হালিমা খাতুন, রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের মনিরা খাতুন, ইংরেজি বিভাগের কামরুন্নাহার কেমি, ইসলামের ইতিহাস বিভাগের রাবেয়া খাতুন, গণিত বিভাগের অচেনা শিক্ষক সহ বিভিন্ন বিভাগের ৭ জন শিক্ষক।
এরা সকলেই অনার্স শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে অনার্স ও মাষ্টার্স শাখায় কর্মরত আছেন। তৃতীয় শিক্ষক নীতিমালা না মেনে এদের তৃতীয় শিক্ষক হিসেবে অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্য ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে তাদের নাম সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রেরণ করেছেন। শুধু তাই নয়, দৌলতপুর কলেজে প্রতি বিভাগে একজন করে পিওন ও অফিস সহকারী নিয়োগ দিয়ে তাদের কাছ থেকেও প্রায় এককোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন অধ্যক্ষ ছাদিকুজ্জামান খান সুমন। এছাড়াও তিনি দৌলতপুর কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দিয়ে বাংলা, ইংরেজি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ভূ-গোল, হিসাব বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস সহ বিভিন্ন বিভাগের অনার্স ও মাষ্টার্স শাখায় ব্যাকডেটে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে জনপ্রতি ৫-৭ লক্ষ টাকা নিয়ে এককোটি টাকারও বেশী নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন অধ্যক্ষ সুমন।
শুধু তাই নয় দৌলতপুর কলেজের কারিগরি (বিএম) শাখা এমপিও হলে ওই শাখার শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকেও অর্ধকোটি টাকা নিয়ে তাদের বেতন কার্যক্রম সম্পাদনে সহায়তা করেছেন। একইভাবে নিবন্ধনধারী শিক্ষকদের দৌলতপুর কলেজে পদায়ন করা হলে তাদের বেতন বিলে স্বাক্ষর করতেও মোটা অংকের টাকা নিয়ে থাকেন তিনি।
কুষ্টিয়া-১ দৌলতপুর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এ্যাড. আ. কা. ম. সরওয়ার জাহান বাদশাহর মাধ্যমে আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফের বড়ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা রাশিদুল আলমকে দিয়ে দৌলতপুর কলেজকে সরকারী করা হবে বলে কলেজের সকল শিক্ষক ও কর্মচারীদের কাছ থেকে প্রায় অর্ধকোটি টাকা জোরপূর্বক আদায় করে সমুদয় অর্থ আত্মসাত করেছেন অধ্যক্ষ সুমন এমন অভিযোগ কলেজের শিক্ষকদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে।
এর বাইরেও ছাত্রদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে সমুদয় অর্থ নিজ পকেটে ভরে থাকেন। ছাত্রপ্রতি সেমিনার ফি, লাইব্রেরী ফি, খেলা-ধুলা না হলেও বার্ষিক ক্রীড়া ফি, উন্নয়ন ফি সহ বিভিন্ন ধরণের ফি বছরে দু’বার করে নিয়ে থাকেন। কলেজের অভ্যন্তরীন পরীক্ষার ফি আদায় করা হলেও শিক্ষকদের টাকা না দিয়ে পরীক্ষার ডিউটি করিয়ে সমুদয় অর্থ হাতিয়ে থাকেন তিনি। কেউ মুখ খুললেই তাকে শোকজ ও হয়রানি করা হয়। চলতি দ্বাদশ শ্রেণীর ফরম ফিলাপে ১৫ হাজার থেকে ১৭ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়েছে এমন অভিযোগ রয়েছে ছাত্র ও অভিভাবকদের।
সিইডিপি (কলেজ এডুকেশন ডেভোলপমেন্ট প্রোগ্রাম) এর আওতায় দৌলতপুর কলেজে ৪ কোটি টাকা বরাদ্দ হলে দরপত্রের মাধ্যেমে বেনামে কাজ নিয়ে সেসব কাজও নি¤œমানের করে সেখান থেকেও বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন অধ্যক্ষ ছাদিকুজ্জামান খান সুমন।
আর কলেজ থেকে হাতিয়ে নেওয়া কোটি কোটি টাকা দিয়ে দৌলতপুর মাষ্টার পাড়ায় লিপ্টযুক্ত বিলাশবহুল দু’টি ৭ তলা ভবন, কলেজ সংলগ্ন মাঠে খামারসহ প্রায় ২০ বিঘা জমি, কুষ্টিয়ায় পরিমল টাওয়ার সংলগ্ন বাটা ভবনসহ কুষ্টিয়া শহরে দু’টি বাড়ি। ঢাকাতেও প্লট কিনেছেন এমন তথ্য এলাকায় লোকমুখে প্রচার রয়েছে।
এছাড়াও তিনি কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে খলিসাকুন্ডি ডিগ্রি কলেজের পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও গোয়ালগ্রাম ডিগ্রি কলেজের সভাপতি হয়ে ওইসব প্রতিষ্ঠানেও একই কর্মকান্ডে লিপ্ত রয়েছেন।
অধ্যক্ষ মো. ছাদিকুজ্জামান খান সুমনের দূর্নীতির বিষয়ে দৌলতপুর কলেজের ভূগোল বিভাগের প্রদর্শক জহরুল আলম বলেন, ২০১৭ সালের ৫ই জুন থেকে সরকার প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কলেজে শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ রেখেছে, অথচ এর পরের বছর গুলোতেও অনিয়মের মাধ্যমে ১১ জন শিক্ষকের বেতন ভাতা কিভাবে হয়েছে, তা তদন্ত করলেই অনিয়ম দুর্নীতি বেরিয়ে আসবে। অনার্সের আরো ৭ জন শিক্ষকের কাছ থেকে ২০ লক্ষ করে টাকা নিয়ে অবৈধভাবে তাদের বেতন করানোর কার্যক্রম চলামান রেখেছেন। যা দৌলতপুর কলেজের সবাই জানে।
তবে অধ্যক্ষ ছাদিকুজ্জামান খান সুমন তার বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এসব তথ্য মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। আমার বিরুদ্ধে জহুরুলরা অপপ্রচার চালাচ্ছে, ১৮ সালের পর থেকে কলেজে কোন শিক্ষক নিয়োগ নাই, নতুন শিক্ষক নিয়োগে ডিজির ও বোর্ডের প্রতিনিধি লাগে, সেখানে আমি একা শিক্ষক নিয়োগ দিব কিভাবে।
দৌলতপুর কলেজের অধ্যক্ষের অনিয়ম ও দূর্নীতের বিষয়ে দৌলতপুর কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি এ্যাড. হাসানুল আসকার হাসু বলেন, আমি কোন অবৈধ টাকা পয়সা খাই না, কলেজে কোন নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে কিনা এ বিষয়ে আমি কিছুই জানিনা।
এবিষয়ে দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ওবায়দুল্লাহ বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই, আমি খোঁজ নিয়ে দেখবো।
সর্বপরি দৌলতপুর কলেজের অধ্যক্ষ মো. ছাদিকুজ্জামান খান সুমনের অনিয়ম ও দূর্নীতির বিষয়ে সুষ্ঠ তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ সহ তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি ভূক্তভোগী সহ দৌলতপুরের সচেতন মহলের।