গাধা ও হাতির প্রতীকে শেষ হলো বাইডেন ও ট্রাম্পের মধ্যকার উত্তেজনায় শিহরণ জাগানিয়া ভোট লড়াই। গাধার পিঠে চড়ে উগ্র ডানপন্থী হস্তি বাহিনীর সর্দার রিপাবলিকান ট্রাম্পকে হারিয়ে ডেমোক্র্যাট বাইডেন চলেছেন হোয়াইট হাউসে, মার্কিন গণতন্ত্রের মানবিক রূপ ফিরিয়ে আসার চ্যালেঞ্জ সফলের লক্ষ্যে। সঙ্গে নিয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত কমলা হ্যারিসকে, যিনি মার্কিন ইতিহাসে প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্টই শুধু নন, প্রথম অশ্বেতাঙ্গ ভাইস প্রেসিডেন্টও বটে।
তীব্র নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে শীর্ষে পৌঁছেছেন বাইডেন-কমলা জুটি। সামনেও তাদের জন্য চ্যালেঞ্জে-ভরা পথ অপেক্ষমাণ। বৈশ্বিক মহামারির সবচেয়ে বড় আঘাতে পর্যুদস্ত যুক্তরাষ্ট্রকে সামলানো, আর্থিক মন্দা কাটানো, কর্মসংস্থান বাড়ানো, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিভাজন কমানো, ট্রাম্পের ‘আমরা বনাম ওরা’ বলে যে হিংসা, তাকে মিটানো নতুন নেতৃত্বের প্রাথমিক দায়িত্ব। বিশ্বব্যাপী মার্কিন গণতান্ত্রিক চেহারা ও মানবিক-বহুত্ববাদী ইমেজ যেভাবে ম্লান ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল, তাকে উজ্জ্বল করার কর্তব্যেও বর্তায় বাইডেন-কমলা জুটির উপর। ফলে ভোটের চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই সামনের দিনগুলোতে চলতে হবে নবনির্বাচিত মার্কিন কর্ণধরদের।
বাইডেন-কমলার ক্ষমতায় আসার পুরোটা পথই ছিল চ্যালেঞ্জে ভরপুর। মার্কিন দেশের শত বছরের ইতিহাসে এমন নাটকীয় ও উত্তেজক নির্বাচন আরেকটিও হয়নি। নির্বাচন-পরবর্তী বাহাত্তর ঘণ্টা ধরেই চলেছে টানটান উদ্বেগ। তিন দিনে ফলাফল নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিস্তর আলোচনা হয়েছে। বারবার বদলেছে তথ্য, পরিসংখ্যানের ভোটচিত্র।
তবে একমাত্র ট্রাম্প ছাড়া সকলের বারবার বলেছেন, বাইডেন ভোট শতাংশে এগিয়ে এবং তারই জয়ের সম্ভাবনা বেশি। সেটাই মিলেছে। কিন্তু নির্বাচনের মূল চ্যালেঞ্জ ছিল এটাই যে, ট্রাম্পও জিতে যেতে পারতেন। একেবারেই সম্ভাবনার সামান্য পরিবর্তন তার দুর্ভাগ্যের কারণ। নির্বাচন যেন একপর্যায়ে পাটিগণিতের অঙ্ক কষার খেয়ালি খেলায় পরিণত হয়েছিল।
হিসাবের দিকে তাকানো যেতে পারে। নির্বাচনে ভোট পড়েছে সাড়ে ১৪ কোটির মতো, আর তার মধ্যে ১০ কোটির বেশি ভোটের দিনের আগে। অক্টোবর মাসে শোনা যাচ্ছিল প্রায় ৮-১০ শতাংশ ভোটে পিছিয়ে ট্রাম্প। তেমনটা যে পরিস্থিতি নয় সেটা অবশ্য বোঝা গিয়েছিল নির্বাচনের আগে আগেই। শেষ বাজারে নিজের দিকে হাওয়া অনেকটা ঘুরিয়ে এনেছিলেন তিনি, গতবারের মতোই। শেষ ফলে তিনি পিছিয়ে আনুমানিক তিন শতাংশ ভোটে। কিন্তু যে জায়গাটায় দেরি হয়ে গেলো, তা হলো, আগে ভোট জোগাড় করায় এ বার অনেক বেশি পারদর্শিতা দেখিয়েছে ডেমোক্র্যাটরা।
মার্কিন দেশে ‘আর্লি পোলিং’, ‘অ্যাবসেন্টি ব্যালট’, এ সব কথার আড়ালে আসলে যে আগে থেকে অন্যের ভোট বান্ডিলে বান্ডিলে জোগাড় করার কৌশল, তার সুফল পেলেন বাইডেন। বুথে গিয়ে ভোটার দেখেন আশেপাশে কেউ নেই। শেষ মুহূর্তে নিজের ইচ্ছায় যা খুশি তাই করতে পারেন স্বাধীন ভোটার। কিন্তু আগে থেকে ক্যাম্পেইন করে ভোটকে প্রভাবিত করার সুযোগ বেশি। ডেমোক্র্যাটরা সে সুযোগ ভালো করেই কাজে লাগিয়েছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মহামারি কোভিড পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ডেমোক্র্যাটরা তাদের সমর্থকদের একটা বিরাট অংশকে আগে থেকে প্রভাবিত করতে পেরেছে। সেটা না হলে এর মধ্যে সামান্য অংশও যদি অন্য দিকে ঘুরে যেত, তা হলে আবার আসনের হিসেবে ট্রাম্পই জিততেন। তার কারণ যে ক’টি রাজ্যে শেষের দিকে ট্রাম্প হেরেছেন সেখানে ব্যবধান খুবই কম।
মোট কথায়, সারা যুক্তরাষ্ট্রে ভোট শতাংশে অনেক এগিয়ে থাকলেও লাভ নেই, বরং কম ব্যবধানে এক একটি রাজ্য জিতে নিয়ে সেখানকার সব আসন বগলদাবা করাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শেষ দিক পর্যন্ত যে রাজ্যগুলোতে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে— জর্জিয়া (১৬), মিশিগান (১৬), নেভাদা (৬), আরিজোয়ানা (১১), উইসকনসিন (১০) আর পেনসিলভেনিয়া (২০)। এগুলোর মধ্যে বেশির ভাগ জায়গাতেই ট্রাম্প শুরুর দিকে যথেষ্ট এগিয়ে ছিলেন। ফলে সেই সময় গণনা শুরুর মাঝরাতে তিনি যে হঠাৎ লাফিয়ে উঠে জিতে গেছি বলেছিলেন, তাতে খুব ভুল নেই। কারণ এটা বুঝতে তার তখনও বাকি ছিল যে, আগে দেওয়া ভোটের সাঙ্ঘাতিক বড় অংশ তার বিরুদ্ধে গেছে। সেটাও অবশ্য একটু পরেই তাকে দলের লোক বুঝিয়ে দিয়ে যায়।
আর তখন থেকে তার দাবি, ভোট না গোনার। খুবই স্বাভাবিক বক্তব্য। জেনেই যদি যাই যে বাকি বান্ডিলগুলোতে নিজের সর্বনাশ লেখা আছে, তখন গণনা বন্ধই জেতার একমাত্র পথ। সেটা শেষ পর্যন্ত ঘটেনি, আর তাই গণনা শেষে হেসেছেন বাইডেন।
মিশিগান এবং পেনসিলভেনিয়াতে যে ভাবে প্রচুর পিছিয়ে থেকেও শেষ মুহূর্তে ট্রাম্পকে টপকে গেছেন বাইডেন, তার মধ্যে রয়েছে জনসমর্থনের থেকেও অনেক বেশি রাজনৈতিক পেশাদারিত্ব। ডেমোক্র্যাটদের এই আগাম ভোট যে মানুষগুলো নেতৃত্ব দিয়ে জোগাড় করেছেন ৩ নভেম্বর অর্থাৎ মূল নির্বাচনের দিনের আগে, তারা যে ভাল সংগঠক তা নিয়ে সন্দেহ নেই। ট্রাম্প অতিরিক্ত আশাবাদী হয়ে সেখানে হেরে গেছেন।
হারার প্রেক্ষাপট আগেই তৈরি হয়েছিল। ট্রাম্প সরকার মার্চ-এপ্রিলে কোভিড জমানার শুরুতেই মানুষের কাছে অর্থসাহায্য পৌঁছে দিয়েছিলেন। অনেক করদাতা কয়েকশো বা হাজার ডলার পেয়েছেন সে দেশে বসে থেকে। শুধু আমেরিকার নাগরিক নন, অন্য দেশের মানুষও, যারা আমেরিকায় কর দেন, তারাও এই সুবিধে পেয়েছেন। মুশকিল হল এর পর থেকেই। জনগণের কাছে এই ধরনের অর্থ সাহায্য দ্বিতীয় বার পৌঁছে দেওয়া গেল না। আমেরিকায় পার্লামেন্টের দু’টি ভাগ আছে— হাউস আর সেনেট। হাউসে রাজত্ব করছে ডেমোক্র্যাটরা, আর সেনেটে রিপাবলিকান।
দ্বিতীয়বারের সাহায্যের কথা যখন উঠতে শুরু করল, আগস্ট-সেপ্টেম্বরে, তখন এক কথায় তাতে সায় দিল ডেমোক্র্যাটদের দখলে থাকা হাউস। হিসেবের কাগজপত্রও বানিয়ে দিল তারা। কিন্তু সেনেটে গিয়েই বিষয়টা গুলিয়ে গেল। মনে রাখতে হবে, এতে যেমন রাজনৈতিক কারণে ট্রাম্পের সায় থাকতে পারে, তেমনই রিপাবলিকানদের মধ্যে যে ট্রাম্প বিরোধীরা আছেন, তাদের চক্রান্তও অসম্ভব নয়। দলে অন্তর্দ্বন্দ্ব শুধু উন্নয়নশীল বিশ্বের রাজনীতির বিষয় নয়, মার্কিন দেশেও তেমনি হওয়া সম্ভব।
ট্রাম্পের পরাজয়ের আরো কারণ দেখা গেছে। একটি হল, কালো মানুষদের ওপর নির্যাতন নিয়ে বিপুল প্রচার। এর ফলেই সে দেশের উদারবাদী মানুষদের একাংশ ট্রাম্পের ওপর বিপুল চটেছেন। আর থাকল সময় মতো কোভিড প্রতিষেধক আবিষ্কার না-হওয়া। বিজ্ঞানকে খুব একটা দখল করতে পারেননি ট্রাম্প। ভোটপ্রচারে ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিলেও তাড়াহুড়ো করে প্রতিষেধক নামিয়ে দেওয়ার মত সাহসী কাজ তিনি করে উঠতে পারেননি।
ট্রাম্পের পরাজয়ে বাইডেনের জয়ের চেয়ে অধিক আলোচিত গণতন্ত্রের বিজয় বলে। মানুষও ভোট দিয়ে রেকর্ড করেছেন। তবে হেরে গিয়েও হার না-মানার খেলায় নেমেছেন দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রনায়ক। মার্কিন দেশে এখনও তিনি দু’মাসের ওপর ক্ষমতায় থাকবেন। ভোটফল বেরিয়ে গেলেও সে দেশে ক্ষমতার হাতবদল হয় পরের বছর। সুতরাং ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা।
ভোটের শেষে ট্রাম্পের মতো এক দক্ষিণপন্থী আগ্রাসী নেতা যে হেরেছেন, তাতে সারা বিশ্ব খুশি। তবে ট্রাম্পের রেশ শুধু ভোটেই মুছে যাবে না। মার্কিন রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের মূল উৎপাটনেরও দরকার পড়বে। বর্ণবাদ, শ্বেতাঙ্গ আগ্রাসন, সংখ্যালঘু ও অভিবাসী বিরোধী মনোভাবের যে বিষবাষ্প এতো দিনে ছড়িয়েছে, তাকে কাবু করাও বাইডেন-কমলা নতুন নেতৃত্ব-জুটির বড়ো চ্যালেঞ্জ।