রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৪৩ অপরাহ্ন

রাশেদ হাসানের গল্প ভয়ংকর প্রতিশোধ (পর্ব-৩)

রাশেদ হাসান / ৫১৫ বার নিউজটি পড়া হয়েছে
আপডেট টাইম: বৃহস্পতিবার, ৩ জুন, ২০২১, ৬:২২ অপরাহ্ন
ইলাস্ট্রেশন : নিপুন কুন্ডু

নূর মিয়া প্রথমে আকবরের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।  ঘটনা কি জানার জন্য তার মন ব্যাকুল হয়ে উঠে। কিভাবে সে খোকসা ঘাটে গেলো তার মনেও এই সন্দেহ দানা বাঁধে।

আকবারের বাড়িতে যাওয়ার পরে নূর দেখতে পায় আকবরের মা আর তার মা বারান্দায় বাঁশের খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে অঝোরে কান্না করছে। লাশ এখনো বাড়িতে আসে নাই। ময়না তদন্তের জন্য কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।কাউকে যে জিজ্ঞাসা করবে কেন, কিভাবে আকবার খোকসা ঘাটে রাতে গেলো, সেই দুঃসাহস নূর মিয়ার মধ্যে আসে না।

বাড়ি ফিরে শাবল, কোদাল আর প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে কবর খোঁড়ার উদ্দেশ্যে কবরস্থানের পথে রওনা দেয় নূর মিয়া।
জোড়া কবর কাটা লাগবে, একা সামলানো বেশ কঠিন। সহকারী হিসেবে এলাকার একজনকে সাথে নিয়ে যায় নূর মিয়া। লোকটার নাম জমির। নূরের থেকে বয়সে অনেক ছোট।
কবরস্থানে গিয়ে পারফেক্ট একটা জায়গা খুঁজতে থাকে দুজনে। জোড়া কবর যেহেতু,  তাই তারা সিদ্ধান্ত নেয় পাশাপাশিই কাঁটবে।

কবর খোঁড়ার সময় নূর মিয়া কোনো সময় চুপ করে থাকে না। হয় দোয়া, নাহলে দরুদ পাঠ করে তা ভালো করেই জানা ছিলো জমিরের।জমির নূর মিয়াকে এমন চুপ করে থাকা দেখে প্রশ্ন করে,
– চাচা, আজ কি মন খারাপ নাকি? চুপ করে আছেন যে?
নূর মিয়া তখনো শুনতে পায়নি জমির তাকে কি প্রশ্ন করেছে। নূর মিয়াকে অন্যমনষ্ক  দেখে জমির আবারো জিজ্ঞাসা করে,
– ও চাচা, চাচীর সাথে আজ ঝগড়া করে আসছেন নাকি? একদম মনমরা হয়ে আছেন?

নূর মিয়া যেন এই ধাক্কায় সম্ভিত ফিরে পায়। জমিরের দিকে তাকিয়ে বলে,
– আরেহ নাহ, জমির কি যে বলো না। এই বয়সে কেউ ঝগড়া করে? আর তোমার চাচীর সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক এখনো আছে। তোমার চাচী লোক ভালো!কবর খুঁড়তে আসছি দুজন, যার যার কাজ করি। আর গল্প করলেও দুনিয়াবী গল্প বাদ দাও, আমাদের মরার পরে কে কবর কাটবে সেই চিন্তা কি একবারের জন্যেও হয়না?
কাজ করো জমির,  কাজ করো।

জমির আর একটা কথাও বলে না। বয়োবৃদ্ধ একটা লোক যখন এভাবে বলে তখন আর কিছু বলার থাকে না।
সাড়ে তিন হাত গভীর দুটো গর্ত খুঁড়তে দুজনের চারঘণ্টার উপরে লেগে যায়।নূর মিয়ার প্রশ্ন এইখানেই,তাহলে রাতে এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে কবর খুঁড়লো সে?নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকে আর সবকিছু গোছাইতে থাকে।

বাড়ি ফেরা পথে নূর মিয়া জমিরকে প্রশ্ন করে,
– আচ্ছা,  জমির। আকবার আর শহিদ দুজনেই তো গরুর ব্যবসা করতো? তাইনা?
– হ চাচা। আমি তো হালকা হালকা শুনতেছি গরু চুরি করতে গিয়ে ধরা খায়ছে। তাই নদীর ওপারের লোকজন মারে নদীতে ভাসাইয়া দিছে। ওপারের লোকজন যে খারাপের খারাপ ভাই!
– এই ব্যাটা, তোমারে কোন পাড়ের লোক ভালো, কোন পাড়ের লোক খারাপ এটা কখনো জিজ্ঞাসা করেছি?
জমির আমতা আমতা করতে করতে বলে,- আচ্ছা আর কিছু বলতেছি না।
এরপরে দুজনে চুপচাপ বাড়ির পথে রওনা দেয়।

সন্ধ্যার পরে দুজনের লাশ একসাথে এলাকার স্কুল মাঠে নিয়ে আসা হয়। এম্বুলেন্স গ্রামের পথে ঢোকার মতো জায়গা না থাকায় সিদ্ধান্ত হয় স্কুলের মাঠে নামিয়ে তারপর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে।
নূর মিয়ার গ্রামের একটা নামকরা ডাক্তার (যিনি কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে চাকরি করেন)  তিনিও সেখানে উপস্থিত। নূর মিয়া তাকে গিয়ে প্রশ্ন করে,

-কি কারণে মরেছে জানো নাকি শফিক?- নাহ চাচা, তবে যেই ডাক্তার কাঁটে সে বললো ভেতরে খালি পানিই পাওয়া গেছে!
নূর মিয়া আর কথা বাড়ায় না। তার ধারণা সত্যি। সে রাতে যা দেখেছে সব সত্যি। এই দুজনকে খুন করেছে তাহলে ওই রাতের লোকগুলো। শাহিন নামের লোকটি যাদের কথা বলেছে তারাই এই প্রতিশোধ নিয়েছে!কিন্তু কেন আকবার আর শহিদ। তাদের দোষ কি? এই কথার উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত কোনো কিছুই জানা সম্ভব না।
এলাকার মুরব্বী আর মসজিদের ইমাম মিলে সিদ্ধান্ত নেয় আগে শহিদ তারপরে আকবরের লাশ দাফন করা হবে। যেহেতু খাটিয়া একটা।

সবকিছু রেডি করে আকবরের লাশ নিয়ে সবাই কবরস্থানের পথে পা বাড়ায়।শহিদের আর আকবরের বাড়ি যেহেতু পাশাপাশি  তাই সবাই চলে এসেছে কবরস্থানে। আকবরের মা, বউ আর ছোট মেয়েটা বাড়িতে। একটা ছেলে মানুষও নাই।

শহিদের লাশ দাফন করে যাওয়ার পরে সবাই আকবরের বাড়িতে যায়। গিয়ে সবাই অবাক,
আকবরের মা,  বউ আর ছোট মেয়েটা উঠোনে পড়ে আছে অজ্ঞান হয়ে। আপনজনেরা দৌঁড়ে গিয়ে তাদের উঠিয়ে মুখে পানির ছিটা দেয়। তারপরে তাদের জিজ্ঞাসা করে কি সমস্যা?

আকবরের বউয়ের ভাষ্যমতে,আপনারা সবাই চলে যাওয়ার পরে মিতু (আকবরের মেয়ে) আর আমি বারান্দায় বসে ছিলাম। মা টয়লেটে চলে যায়। হঠাৎ মিতু বলে উঠে মা দেখো,আব্বু উঠে বসে আছে। আমি ওর কথায় খাঁটিয়ার দিকে তাকাতেই দেখি মিতুর আব্বুর মরদেহ বসা অবস্থা থেকে শুয়ে পড়লো। দুজনেরই চোখের ভুল ভেবে আমি মিতুকে স্বান্তনা দিতে থাকি। কিন্তু একটু পর হঠাৎ কিছু একটা খাওয়ার শব্দ আসতে থাকে খাটিয়ার মধ্য থেকে। হাঁড় চাবানোর শব্দের মতো। ততক্ষণে মা চলে এসেছে। মা ও সেই শব্দ শুনতে পায়। তারপর তিনজন মিলে খাটিয়ার কাছে গিয়ে দেখি ওর আব্বু নিজের হাত নিজেই চিবিয়ে খাচ্ছে। এটা দেখার পরে আমরা অজ্ঞান হয়ে যাই।

সবাই দৌঁড়ে ততক্ষণে লাশের কাছে যায়। গিয়ে দেখে খাটিয়ার মধ্যে কোনো কিছুই নেই।এই দৃশ্য থেকে পুরো এলাকার লোকজন হতভম্ব হয়ে যায়। কেউ কেউ বলতে থাকে হয়তোবা শেয়ালে লাশ টেনে নিয়ে গেছে।কেউ বলে কাপনের কাপড় চুরি করার কোনো গ্যাং থাকতে পারে। তারা দেখো নিয়ে গিয়েছে কিনা?

সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয় লাশ খুঁজতে বের হবে সবাই দলে দলে।চারদলে বিভক্ত হয়ে চারদিকে লোকজন যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।স্বজনদের কান্নার আহাজারি আর ভয়ে সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এমন ঘটনা আগে কোনোদিন এই এলাকাতে ঘটেনি।

নূর মিয়া কোনো দলের সাথেই যায় না। সারাদিনের ধকল আর রাতের সেই কথাগুলো তার মাথায় ঘুরপাক খায়তে থাকে। একা একা অন্ধকার রাস্তায় বাড়ির পথে রওনা দেয় সে। হঠাৎ পেছন থেকে একটা লোক অতিদ্রুত তার সামনে চলে আসে। পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। নীরবতা ভেঙে সেই লোকটা হঠাৎ বলে উঠে,- নূর মিয়া। আমার কথা কি সত্য হয়েছে? দুজনের জন্য কবর কাঁটতে বলেছিলাম না? দুজনের লাশ পাওয়া গেছে তো?আরো অনেকের কবর তোকেই খুঁড়তে হবে।

আমার ভাতিজাকে খুনের পেছনে যারা আছে সবাইকে তার মা মেরে ফেলবে। আমরা জ্বীন জাতি, আমাদের প্রতিশোধ কতটা ভয়ংকর হতে পারে তা মানুষ কোনোদিন কল্পনাও করতে পারবে না।

আপনি ভয় পাবেন না। আপনার কোনো ক্ষতি আমরা করবো না। শুধু এটুকু বলতে চাই, তারা ১১ জনের গ্রুপ ছিলো সাথে একটা কবিরাজ ছিলো। এক এক করে সবাইকে মারা হবে। আপনি চাইলেও কিছু করতে পারবেন না।
নূর মিয়া এবার বলে উঠে,
– আকবরের লাশ কই? আপনারা কিছু করেছেন নাকি?- আকবরের লাশ ওদের পুকুর পাড়ের হিঁজল গাছের নীচে আছে। সেই কবিরাজ কাফনের কাপড় চুরি করার জন্যে লাশটাকে জ্বীনের মাধ্যমে হিজল গাছের নীচে নিয়ে গেছে। গিয়ে দেখেন কাফনের কাপড় ছাড়া একটা লাশ পরে আছে।

নূর মিয়া আর কাউকে দেখতে পায়না তার সামনে। তবে শাহিন ছিলো লোকটা এটা বুঝতে পারে। নূর মিয়া দুজন মানুষকে সাথে নিয়ে আকবরের বাড়ির পুকুর পাড়ে হিজল গাছের নীচে চলে যায় এবং গিয়ে দেখে ঘটনা সত্যি।নূর মিয়াকে সবাই জিজ্ঞাসা করে সে কিভাবে জানলো লাশটা এখানে পড়ে আছে?
নূর মিয়া কারো কথার কোনো উত্তর দেয় না। উত্তর দিলেও তার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। তাই চুপ করে থাকাটাই শ্রেয় বলে তার মনে হয়।  তাই সে চুপ করেই থাকে।কবিরাজ নূর মিয়ার এলাকায় তিনজন। তারমধ্যে কে এই কাজ করতে পারে তা বুঝতে পারেনা নূর মিয়া!

সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয় লাশের পাহারায় কয়েকজন থাকবে এবং লাশ দাফন সকালে হবে।
সবাই যে যার বাড়ি চলে চায়। নূর মিয়া বাড়িতে গিয়ে বউয়ের সাথেও কথা বলেনা। খেয়ে নিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ে।
মাঝরাতে নূর মিয়ার ঘুম ভাঙে তার বউয়ের টানাটানিতে। – ওই শুনছো?চৌঁকির নীচ থেকে কিসের যেন শব্দ আসতেছিলো। আমি ভালো করে খেয়াল করার পরে কি যেন রুম থেকে বাইরে চলে গেলো।বিরাট বড় আলোর ঝলকানি হয়ছে।

নূর মিয়া তার ঘড়ির সময় দেখে বউকে বলে,- ঘুমিয়ে পড়। দুঃস্বপ্ন দেখেছো।নূর মিয়ার মুখের উপর কথা বলার দুঃসাহস মিনারার নাই। তাই সে চুপ করে শুয়ে থাকে।
কিছুক্ষণ পরে মিনারা বেগম আবার চিৎকার করে উঠে। এবার নাকি সে স্বপ্নে দেখেছে গ্রামের গরু ব্যবসায়ী আমিরুল মারা গিয়েছে।

চলবে…


আপনার মতামত লিখুন :

Comments are closed.

এ জাতীয় আরো খবর...
এক ক্লিকে বিভাগের খবর