নূর মিয়া লোকটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সুন্দর চেহারার এক বয়স্ক লোক তার হাত ধরে এভাবে মিনতি করছে। অথচ এই ৬০ বছর বয়সে যাকে কখনো কোথাও দেখেনি সে। নূর মিয়ার জবান বন্ধ হয়ে গেছে। সে কিছুই বলতে পারে না। ছেলেটার লাশে খাটিয়ায় রাখা। কবরের পশ্চিম দিকটায় রাখা লাশ। গুনগুন করে দোয়া পড়ার শব্দ তার কানে ভেসে আসছে। শাহিন নামের লোকটা তার কাছে এসে বলে- নূর মিয়া, উপস্থিত সবাই চাচ্ছিলো জানাজার নামাজ যেন আপনি পড়ান। আপনি না করবেন না!
নূর মিয়া উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে দেখে- লোকজনের মধ্যে থেকে কয়েকজন বলে উঠে আল্লাহু আকবার!নূর মিয়ার কথা বলার শক্তি অনেক আগে থেকেই নাই হয়ে গেছে। তাই সে কিছু না বলে জানাজার নামাজ পড়াতে চলে যায়। বহুবার সে এই কাজটি করেছে। এলাকায় বেশ পরিচিত নূর মিয়া। লাশের গোসল করানো, জানাজার নামাজ পড়ানো থেকে শুরু করে দাফন কাফন সে একা সামলানোর উস্তাদ। নূর মিয়া জানাজার নামাজ পড়ানো শেষ করে।
লাশ দাফনের সময় ও নূর মিয়া কবরে নামে। মুখ থেকে কাফনের কাপড় সরানোর সময় নূর মিয়া ছেলেটার চেহারা দেখে সর্বপ্রথম। এতো সুন্দর চেহারার মানুষ সে আগে কখনো দেখেনাই। অজান্তেই তার মুখ থেকে বের হয়ে আসে,’মাশআল্লাহ ‘। কিন্তু তার ঠোঁট নীল বর্ণ ধারণ করে আছে। ছেলেটার বয়স কত হবে তা আন্দাজ করতে পারে না নূর মিয়া। মাথায় রাখে প্রশ্নটা যাওয়ার সময় করবে শাহিনকে।
সবকিছু শেষ করে নূর মিয়া বাড়ি ফেরা জন্য প্রস্তুত হলে সবাই মিলে নূর মিয়াকে সালাম দেয়। ঘোড়ার গাড়ি চেপে শাহিন নূর মিয়াকে তার বাড়ির সামনে এনে নামিয়ে দেয়। নূর মিয়া ঘরে যাওয়ার আগে পিছনে ঘুরে প্রশ্ন করে- বেয়াদবি নিবেন না। আমি এতক্ষণে বুঝতে পেরে গেছি আপনারা কারা। কোন জাতি? কিন্তু আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিলে আমি খুব খুশি হতাম!
শাহিন বলে। আপনার প্রশ্নের জবাব আমি দিয়ে দিচ্ছি। আমার ভাতিজার বয়স ২৪০ বছর হয়েছিলো। তাকে পানিতে ডুবিয়ে মারা হয়েছে। নূর মিয়া এই কাজ করেছে তোমার এলাকার কিছু মানুষ আর একটা কবিরাজ। তার মা খুবই প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে আছে। সবাইকে একে একে শেষ করবে সে। তাই আপাতত আমি আর কিছু বলছিনা। আপনার সব প্রশ্নের উত্তর আপনি পেয়ে যাবেন সময় মতো। তবে এখন গিয়ে ভালোমতো ঘুমান। সকালে দুটো কবর খোঁড়া লাগবে।
চোখের পলকে ঘোড়ার গাড়িসহ শাহিন নামের লোকটি গায়েব হয়ে যায়। দ্রুত পা ফেলে নূর মিয়া ঘরে চলে যায়। তার ঘড়িতে তখনো ৫ টা বাজেনি। ক্লান্ত দেহ থাকায় সে ঘুমিয়ে যায়। আজানের শব্দে তার ঘুম ভাঙে। বড়জোর মিনিট বিশের ঘুম হয়েছে তার। ঘুমে সে অনেক কিছু দেখেছে। একটা স্বপ্নই দুইবার দেখেছে। যেখানে সে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে খোকসা ঘাটে দুইটা লাশ। কার লাশ সে তা বুঝতে পারে নাই। কিন্তু সে দেখেছে দুটো লাশ পড়ে আছে। আর ভোর রাতের স্বপ্ন সত্যি হয় বলে একটা ধারণা তার আছে। তার বউকে কিছু জানায় না সে, ঘুম থেকে উঠে ওযু করে মসজিদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে নূর মিয়া।
তার অভ্যাস মোতাবেক সবাইকে নামাজের জন্য ডাকতে ডাকতে মসজিদে চলে যায় নূর মিয়া। মসজিদে গিয়ে কারোর মরার খবর পায় না সে। নামাজ শেষ করে মসজিদ থেকে চলে আসে নূর মিয়া। তখন সে ধরে নেয় রাতে যা হয়েছে সবকিছুই স্বপ্ন। আর নাহলে লোকটার কথা মিথ্যা। বাড়িতে এসে পান্তাভাতে পেঁয়াজ আর কাঁচামরিচ ডলা দেওয়ার সময় মসজিদের মাইক থেকে ভেসে আসে দুইটা মানুষের মৃত্যুর সংবাদ৷ মুয়াজ্জিন পরপর দুইবার দুজনের নাম বলার পরে গলায় ভাত আঁটকে যায় নূর মিয়ার! তার গলায় ভাত আঁটকানো দেখে মিনারা বেগম পানির গ্লাস নিয়ে তার দিকে দৌঁড়ে আসে। বিড়বিড় করে বলতে থাকে- মানুষের মরার কথা শুনে তোমার গলায় ভাত আটকায় কেন?
শান্তি করে ভাতটাও খায়তে পারে না। মরার খবর বলার সময় ও পায় না মানুষ। সারাদিন কেমন যাবে আল্লাহ মাবূদ জানে, সকালবেলা মরার খবর। এসব বলে নূর মিয়াকে পানি খাইয়ে তার বউ চলে যায়। নূর মিয়া বিস্তারিত জানার জন্য মৃত ব্যক্তিদের বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। পথে তার শরিফুলের সাথে দেখা। হাউমাউ করে কান্না করতে করতে শরিফুল বলে-দাদা, আকবার আর শহিদ কালকে রাতেও আমার সাথে ছিলো। আর এখন তাদের মরা বলে খোকসা ঘাটে পাওয়া গেছে। ওরা ওখানে কী করতে গেলো? ওরা মরে নাই দাদা, কেউ মেরে ফেলেছে!
নূর মিয়া কিছু না বলে অবাক পানে চেয়ে থাকে।
চলবে…