উপকূলের নদ-নদীতে অধিক উচ্চতার জোয়ার এ অঞ্চলে নতুন দুর্যোগে রূপ নিয়েছে। বরিশালসহ দক্ষিণ উপকূলের জেলাগুলোতে গত সোমবার থেকে দিন-রাতে দুবার করে ১০ থেকে ১৪ ফুট উচ্চতার জোয়ারের পানিতে ভাসছে লাখো পরিবার। ঘরদোরে বুকসমান পানি ওঠায় স্বাভাবিক জীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। ঘের-পুকুরের মাছ, খেতের ফসল ভেসে গেছে। জোয়ারের পানিতে ডুবে মারা পড়েছে ছয় শিশু।
নদ-নদীতে অধিক উচ্চতার জোয়ারের এই প্রবণতার শুরু এক দশক আগে। ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডর থেকে এটা শুরু। এরপর যত ঝড় আঘাত হেনেছে, সব কটিতে জোয়ারের উচ্চতা বেড়েই চলেছে। শুধু ঘূর্ণিঝড় নয়, অমাবস্যা-পূর্ণিমার জোতেও ৮ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার জোয়ারের কবলে পড়ছে লোকালয়। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ছে এ অঞ্চলের মাটি, পানি, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যে।
দুর্যোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ৫০ বছরে দেশে দুর্যোগঝুঁকি মোকাবিলায় সক্ষমতা বাড়ায় প্রাণহানি অনেক কমেছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশে দুর্যোগের সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। এতে গত এক দশকে বেড়েছে জলোচ্ছ্বাসের নীরব ক্ষতি।
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম) বলছে, আগে প্রতি ছয় বছর চার মাসে একটি করে বড় ঘূর্ণিঝড় হতো। এখন প্রতি ১ বছর ১০ মাসে একটি ঝড় আঘাত হানছে দেশে।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাব কেটে গেলেও নদীতে জোয়ারের পানির উচ্চতা কমছে না। বৃহস্পতিবার খুলনার দাকোপে পশুর নদের তীরে বানীশান্তায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাব কেটে গেলেও নদীতে জোয়ারের পানির উচ্চতা কমছে না। বৃহস্পতিবার খুলনার দাকোপে পশুর নদের তীরে বানীশান্তায়ছবি: উত্তম মণ্ডল
স্বাধীনতার আগে উপকূলে বাঁধ না থাকায় ’৬০-এর দশকে বন্যায় বহু লোকের প্রাণহানি হয়। ’৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ে ৫ লাখ থেকে মতান্তরে ১২ লাখের বেশি মানুষ মারা যায়। সম্পদের ক্ষতিও ছিল ব্যাপক। ’৭০-এর ঝড়ে ব্যাপক প্রাণ ও সম্পদহানি হলেও জোয়ারের উচ্চতা ছিল সিডরের চেয়ে অন্তত দুই ফুট কম। তখন বাঁধ ছিল না বলে প্রাণহানি বেড়েছিল। এরপর ’৬০ ও ’৭০-এর দশকে উপকূলীয় এলাকা বাঁধ দিয়ে ঘিরে ফেলার পর জলোচ্ছ্বাসে প্রাণহানি কমে। তবে সিডরের পর সেই পুরোনো দুর্যোগ নতুন করে দেখা দিয়েছে।
দেখা যায়, বরিশালসহ দক্ষিণ উপকূলের নদ-নদীগুলোতে জোয়ারের উচ্চতা গত এক দশকে তিন–চার ফুটের বেশি বেড়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে বঙ্গোপসাগরে ঘন ঘন লঘুচাপ, নিম্নচাপ কিংবা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হচ্ছে। এতে ১০ থেকে ১৪ ফুটের বেশি উচ্চতার জোয়ারের তাণ্ডব চলে ধারাবাহিক। ফলে ৫০ বছর আগের নির্মিত এসব বাঁধ এখনকার অতি উচ্চতার জোয়ার সামাল দিতে পারছে না।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বরগুনার নির্বাহী প্রকৌশলী কাইছার আলম বলেন, ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস রুখে দিতে পারবে, এমন চিন্তা করেই ’৬০ ও ’৭০-এর দশকে বাঁধ করা হয়েছিল। নদীপাড়ে ১০ থেকে ১৩ ফুট এবং অভ্যন্তরে ৮ ফুট উচ্চতার বাঁধ করা হয়েছিল তখন। কিন্তু এখন ১০-১২ ফুট উচ্চতার জোয়ারও রুখতে পারছে না।
পাউবো ও বিভিন্ন সূত্র জানায়, গত বছরের ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে বরিশালসহ দক্ষিণ উপকূলের নদ-নদীতে ৯ থেকে ১৩ ফুট উচ্চতার জোয়ার হয়। এতে বরিশাল অঞ্চলের ৭৬৪টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে ক্ষতির শিকার হয়েছিল প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ মানুষ। আম্পানে ১৬ জনের মৃত্যু এবং সরকারি হিসাবে জলোচ্ছ্বাসে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। সেই রেশ কাটতে না কাটতেই জুনের শেষ সপ্তাহ থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত নিম্নচাপের প্রভাবে পুনরায় ১০ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার জোয়ারে ভাসে উপকূল। এতে বিভাগের সব কটি জেলা, এমনকি বরিশাল নগরের অধিকাংশ সড়ক, বাড়ি, এলাকা প্লাবিত হয়। বরিশাল নগরে এমন জলাবদ্ধতা আর কখনো দেখা যায়নি। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সোমবার থেকে এই অঞ্চলের নদ-নদীগুলোতে অধিক উচ্চতার জোয়ার হচ্ছে। ৮ থেকে ১৪ ফুট উচ্চতার জোয়ারে ভাসছে মানুষের বসতি, ফসল খেত, জনপদ।
জোয়ারের উচ্চতার ভয়াবহতার শুরু ২০০৭ সালের সিডরে। সিডরে জোয়ারের উচ্চতা ছিল প্রায় সাড়ে ১২ ফুট। প্রাণ হারায় সরকারি হিসাবে ৩ হাজার ৩৪৭ জন, বেসরকারি হিসাবে তা ১০ হাজারের ওপরে। সরকারি ক্ষতির বিবরণে ওই ঝড়ে ১ লাখ ৭২ হাজার ৪৫৯ পরিবারের ৮৯ লাখ ২৩ হাজার ২৫৯ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জোয়ারের তাণ্ডবে ৭ লাখ ৪২ হাজার ৮৮০ একর জমির ফসল সম্পূর্ণ এবং ১৭ লাখ ৩০ হাজার একর জমির ফসলের আংশিক ক্ষতি হয়েছিল। ভেসে যায় কয়েক লাখ গবাদিপশু।
বৃহস্পিতবার খোলপেটুয়া নদীর সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার বড়দল ইউনিয়ের নড়েরাবাদ নামক স্থানে
বৃহস্পিতবার খোলপেটুয়া নদীর সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার বড়দল ইউনিয়ের নড়েরাবাদ নামক স্থানে ছবি: প্রথম আলো
২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলোতে প্রায় ৯ দশমিক ৩৪ ফুট উচ্চতার জোয়ার হয়। ঝড়ে প্রাণহানি হয়েছিল অন্তত ১৯৩ জনের। প্রাণহানির চেয়েও ধারাবাহিক উচ্চতর জোয়ারে দীর্ঘ মেয়াদে যে ক্ষতি হয়, তা এখনো কাটিয়ে ওঠা যায়নি। আইলায় খুলনার দাকোপ, কয়রা এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন লোনাপানিতে ডুবে যায়। ৯৭ হাজার একরের আমনখেত লোনাপানিতে সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়। কাজ হারান ৭৩ হাজার কৃষক ও কৃষি–মজুর। আক্রান্ত এলাকাগুলোয় পানীয় জলের উৎস সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড়ের কয়েক মাস পর থেকে এলাকাগুলোয় গাছপালা মরতে শুরু করে ও বিরান ভূমিতে পরিণত হয়। উদ্বাস্তু হয় কয়েক হাজার পরিবার।
২০১৩ সালের ১৬ মের ঘূর্ণিঝড় মহাসেনে জোয়ারের তীব্রতা ছিল সাড়ে ৯ ফুট। মারা যায় ১৭ জন। এরপর ২০১৫ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘কোমেন’–এ নয়জন মারা যায়। জোয়ার আর প্রবল বর্ষণে কক্সবাজারেই ৪০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। ২০১৬ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’ আঘাত হানলে পাঁচ জেলার ২১ লাখ লোককে সরিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়া হয়, মারা যায় ২১ জন। ক্ষয়ক্ষতি ৪০০ কোটি ছাড়িয়ে যায়। ২০১৭ সালের ৩০ মে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’, ২০১৯ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’র আঘাতে মারা যায় নয়জন। প্রাণহানি কম হলেও ১০-১২ ফুটের জোয়ারে সরকারি হিসাবে ঘরবাড়ি, বাঁধ, সড়ক ও কৃষিতে ৫৩৬ কোটি ৬১ লাখ টাকার ক্ষতি হয়। একই বছরের ৯ নভেম্বর অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ আঘাত হানার সময় জোয়ারের উচ্চতা ছিল ৯ থেকে ১২ ফুট। ঝড়ে মারা যায় ২৪ জন। ৭২ হাজার ২১২ টন ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়, যার আর্থিক মূল্য ২৬৩ কোটি ৫ লাখ টাকা। ক্ষতি হয়েছে সুন্দরবনেরও। কিন্তু আম্পান ও ইয়াসে জোয়ারের উচ্চতা ছিল ১৪ ফুটের বেশি।
পাউবো বলছে, ২০০৪ সালে বরিশাল অঞ্চলের প্রধান নদ-নদী বিষখালী-পায়রা-বলেশ্বরে সর্বোচ্চ জোয়ারের উচ্চতা ছিল ৯ দশমিক ৪৫ ফুট, ২০০৫ সালে ৯ দশমিক ৫১ ফুট, ২০০৬ সালে ৬ দশমিক ৯৬ ফুট। এ অঞ্চলের নদ-নদীর স্বাভাবিক জোয়ারের সর্বোচ্চ উচ্চতা ৬ দশমিক ৮৫ ফুট।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপকূল শিক্ষা বিভাগের চেয়ারম্যান হাফিজ আশরাফুল হক বলছিলেন, পানি নামার পথগুলো ভরাট করে গত এক দশকে ব্যাপক নগরায়ণ হয়েছে। ফলে পানি নদী-নালায় সহজে যাচ্ছে না। আগে চারদিকে অনেক জলাধার ছিল। মাটি অনেক বেশি পানি শুষে নিত। এখন সেসবও কমে গেছে, নদীর তলদেশ পলি জমে ভরাট হয়ে বেসিন সংকুচিত হয়েছে। নদী মরে যাচ্ছে। এর ভয়াবহ ও দীর্ঘমেয়াদি ফল ভোগ করছে উপকূলের মানুষ।
পানি বিশেষজ্ঞ ও পাউবোর সাবেক আঞ্চলিক প্রধান প্রকৌশলী সাজেদুর রহমান সরদার বলেন, ‘উপকূলের এই নতুন দুর্যোগ অ্যালার্মিং। বদ্বীপ পরিকল্পনায় নদীগুলোর ডাউনে প্রশস্ততা কমিয়ে এক কিলোমিটার করে গভীরতা বাড়ানোর পরিকল্পনা এর ভয়াবহতাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। তাই নদী সংকোচনের চিন্তাকে যৌক্তিক মনে করি না। কারণ, উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বরফ আরও গলবে, পানি বাড়বে। নদী সংকোচন করা হলে আমাদের নদীগুলোর ধারণক্ষমতা আরও কমবে। তাতে উপকূলে জোয়ারের উচ্চতা আরও বাড়বে। অনেক এলাকা পানিতে নিমজ্জিত হয়ে যেতে পারে। এর চেয়ে নদীকে নদীর মতো থাকতে দেওয়াই এখন গুরুত্বপূর্ণ কাজ।’