-নূর মিয়া, উঠে পড়। খোকসা ঘাটে দুজন পানিতে ডুবে মরে আছে। ওদের লাশ দাফনের জন্য কবর খোঁড়া লাগবে। উঠে পড় নূর, উঠে পড়। আচমকা বিছানা থেকে উঠে বসে নূর মিয়া। তার বউও বিছানায় উঠে বসে বলে- কে ডাকলো তোমারে এতো রাতে?
নূর মিয়া প্রথমে ভেবেছে সে দুঃস্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু বউয়ের সরব তার ধারণা পাল্টে দেয়। স্বপ্ন হলে তো তার বউয়ের শোনার কথা না।
নূর মিয়া হারিকেনের আলো আরেকটু কমিয়ে দিয়ে বললো- ঘুমাও তো মিনারা। সারাদিন বতর তোলা কাজ করতেছো তো, ধকল গেছে তাই দুঃস্বপ্ন দেখেছো। মিনারা বেগম স্বামীর বাধ্য বউ। টু শব্দটি না করেই ঘুমিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে নূর মিয়া হারিকেনের আলো বাড়িয়ে নিয়ে বাইরে বের হয়ে আসে।
বাইরে কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুই শুনতে পায় না সে। সাধারণত গ্রাম এলাকায় কিছু হলে চেঁচামেচি শুরু হয়ে যায়। যা অনেক দূর থেকে শোনা যায়। তেমন কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে নূর মিয়া ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেই শুনতে পায় -নূর মিয়া, কই যাস তুই? তুই তো বড্ড বেশি অলস হয়ে গেছিস। জোড়া কবর কাটবি বলে দিলাম। সকাল হয়ে যাবে। এখনই যা।
নূর মিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে এবার কাউকে দেখতে পায় না। দোয়া-দরুদ পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে ঘরে চলে যায়। সে বুঝতে পারে অস্বাভাবিক কিছু একটা হয়েছে। মিনিট দশেক পরে নূর মিয়ার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে নূর মিয়া রুম থেকে বলে উঠে- কে বাইরে?
– আসসালামু আলাইকুম আমি! আমি শাহিন।
– ওয়া আলাইকুম আসসালাম। আপনাকে চিনলাম না। আপনার বাড়ি কোথায়?
-আমার বাড়ি মোড়াগাছা। আমার আব্বা আপনার কাছে পাঠালো। আমার বড় ভাইয়ের ছেলে মারা গেছে। আপনি নাকি কবর খোঁড়েন তাই এসেছি। আপনাকে সাথে করে নিয়ে যেতে বলেছে।
নূর মিয়া কোনো কথা না বলে তার বিছানার নীচ থেকে ক্যাসিও ঘড়িটা বের করে আলো জ্বেলে দেখে ঘড়িতে সময় ১টা বেজে ১৪ মিনিট। রুম থেকে শাবল আর কোদাল নিয়ে বের হয়ে দেখে লম্বা জোব্বা পরিহিত একটা লোক তার দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ধবধবে সাদা জোব্বা পড়া লোকটার শরীর দিয়ে নূরের ঝলকানি বের হচ্ছে, সাথে একটা সুগন্ধিতে ম ম করছে তার চারিদিক। নূর মিয়া তার সাইকেল বের করতে গেলে লোকটা বলে উঠে সাইকেল বের করা লাগবেনা নূর সাহেব। আমার গাড়িতে করে আপনি চলেন। ওই যে আমার গাড়ি।
কথাটা শোনার পর সামনের দিকে তাকিয়ে নূর মিয়া দেখতে পায় একটা ঘোড়ার গাড়ি সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নূর মিয়া অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে শাহিন নামের লোকটা তাকে বলে- চলেন দেরি হয়ে যাচ্ছে। সবাই চাচ্ছে রাতারাতি দাফন করতে। যেন ফজরের আগে দাফন করে সবাই নামাজ পড়তে পারে। নূর মিয়া কোনো কথা না বলে গাড়িতে বসে পড়ে।
ঘোড়ার গাড়ি যে এতো দ্রুত চলাফেরা করতে পারে। তারপরে আবার অন্ধকারে সেটা বিশ্বাসই করতে পারছিলো না নূর। মনে হচ্ছিলো সে কোনো দ্রুত গতির গাড়িতে বসে আছে। সেসব ভাবতে ভাবতে ঘোড়ার গাড়ি একটা জায়গা এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। নূর মিয়া লোকটার সাথে কথা বলে নামার পরে দেখে, গাড়ি কোনো কবরস্থানে থামেনি। তার অনুধাবন শক্তি আর অভিজ্ঞতা থেকে সে বুঝতে পারলো সে একটা নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আছে।
শাহিন তাকে কবর খুঁড়তে নির্দেশ দিলে নূর মিয়া বলে- বালুর মধ্যে কবর খুঁড়বো কেমন করে? বালু তো চারদিক থেকে ভেঙে পড়বে। লোকটা ইষৎ হেঁসে জবাব দেয়- আল্লাহর নাম নিয়ে কাজ শুরু করো নূর মিয়া। আল্লাহ চাইলে কতকিছুই হয়। নূর মিয়া আর কথা না বলে কবর খুঁড়তে শুরু করে। কবর খোঁড়ার সময় সে ভাবতে থাকে এই লোকটাকে তো সে কখনোই দেখেনি বা চিনেও না। লোকটা তার বাড়ি চিনলো কেমন করে? তাকেই চিনলো কেমন করে? এসবের ঘোরে থাকতে থাকতে নূর মিয়া বুঝতে পারে কবর কাটা শেষ। ঘড়ির আলো আরেকবার জ্বালিয়ে সে দেখে ঘড়ির সময় রাত তিনটা ছত্রিশ মিনিট।
এতো তাড়াতাড়ি কবর কিভাবে খুঁড়লো নূর মিয়া সেটার প্রশ্ন খুঁজতে খুঁজতে সে নদীতে হাত মুখ ধোয়ার জন্য আসে। হাত মুখ ধুয়ে কিনারায় আসতে নূর মিয়া দেখে হাজার খানেক লোক তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। সবার একই ধরনের পোশাক। লোকগুলোর মধ্য থেকে একজন এসে নূর মিয়ার হাত ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে।
– নূর ভাই, আমার ছেলেটা পানিতে ডুবে মারা গেলো। ওরা আমার ছেলেটারে মেরে ফেলেছে। নূর ভাই, আমি জানি কারা আমার ছেলেকে মেরেছে। ওদেরও কী পানিতে ডুবে মরা উচিত না?
চলবে…