লালন সাঁই, মোহিনী মোহন, কাঙাল হরিনাথ, মীর মশাররফ হোসেন, রাধা বিনোদ পাল, প্যারী সুন্দরী, বাঘা যতিন এবং গগণ হরকরা জন্মগ্রহণ করে কুষ্টিয়াকে ধন্য করে গেছেন। আবার রবীন্দ্রনাথ কুষ্টিয়ার রস আস্বাদন করে মহত্ব দিয়েছেন। আরও একজন যিনি একটি জাতির পিতা জীবনের ‘প্রথম পলিটিক্যাল ব্যাটল ফিল্ড’ হিসেবে নিয়ে কুষ্টিয়াকে ধন্য করে গেছেন। যার জন্ম না হলে এ ভূখণ্ডের স্বাধীনতা হতো কিনা তার সন্দেহ আছে।
হ্যাঁ, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কথা বলছি। টুঙ্গিপাড়ার খোকা থেকে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠতে তাকে যে সংগ্রাম ত্যাগ, চড়াই-উৎরাই করতে হয়েছে তার প্রথম আনুষ্ঠানিকতা কুষ্টিয়াতে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোলকাতায় জন্মগ্রহণ করে জমিদারির কাজে এসে কুষ্টিয়ার মানসকে সমৃদ্ধ করেছেন, সমৃদ্ধ হয়েছেন। বাউল শিরোমনি লালন সাঁই, গগণ হরকরার সুর আস্বাদন করেছেন বিশ^কবিও। বাঘা যতিন, রাধা বিনোদ কুষ্টিয়ায় জন্মগ্রহণ করে পুরো ভারতবর্ষের আপনজন হয়েছেন। কুষ্টিয়ার মুখোজ্জ্বল করেছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কুষ্টিয়ায় পরীক্ষার মধ্য দিয়ে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। জীবনের এ পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে হয়তো রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে হঠকারী হিসেবে ছিটকে পড়তে পারতেন। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইতিহাসটাও অন্যরকম হতে পারত। ২০০৪ সালের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা জীবনী উদ্ধার হলে বিষয়টি সামনে আসে।
উনিশ শ’ সালের ৩০-এর দশক। বাংলাজুড়ে যখন ইংরেজ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে উত্তাল। সে সময় কংগ্রেস, মুসলিম লীগসহ সামাজিক সাংস্কৃতিক ও গোপন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সক্রিয় ছিল। আর কোলকাতা ছিল পাইনিয়র। কোলকাতার ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। শুরু থেকেই তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের একজন একনিষ্ঠ রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। যুক্ত হন অল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগের সঙ্গে। গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একনিষ্ট ভক্ত হিসেবে তিনি মূল সংগঠন মুসলিম লীগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। যতটা ছাত্রলীগ বা মুসলিম লীগ নিয়ে তার চেয়ে পাকিস্তান আন্দোলনের কর্মী হিসেবে তৈরি করে তুলছিলেন।
১৯৪৪ সাল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বয়স যখন মাত্র ২৪ বছর; তিনি মুসলিম ছাত্রলীগের অবস্থা দেখে বিচলিত হয়ে পড়লেন। যে অল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করছে, যে মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে সেই সংগঠনের ভ্যানগার্ড ছাত্র সংগঠনের দুর্বল কমিটি থাকবে তাই কী করে হয়! অনেক বছর সম্মেলন হয় না, এটা হতে পারে না। তিনি কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে সাংগঠনিক সফর-কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। আন্তঃস্রোতে বারবার ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অসম্পূর্ণ আত্মজীবনীতে তিনি সে আত্মদহনের কথা লিখে গেছেন।
শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘১৯৪৪ সালে ছাত্রলীগের এক বাৎসরিক সম্মেলন হবে ঠিক হলো। বহুদিন সম্মেলন হয় না। কোলকাতায় আমার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা কিছুটা ছিল, বিশেষ করে ইসলামিয়া কলেজে কেউ আমার বিরুদ্ধে কিছুই করতে সাহস পেত না। আমি সমানভাবে মুসলিম ও ছাত্রলীগে কাজ করতাম। কোলকাতায় সম্মেলন হলে কেউ আমাদের দলের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারবে না। যা হোক, শহীদ সাহেব আনোয়ার সাহেবকে ভালোবাসতেন। আনোয়ার সাহেব অনেকটা অসুস্থ হয়েছেন। ঢাকার ছাত্রলীগ ও আমাদের সঙ্গে কেউ আনোয়ার সাহেবকে দেখতে পারত না। একমাত্র শাহ আজিজুর রহমান ঢাকার আনোয়ার সাহেবের দলে ছিলেন।’
কম বয়সেই মুসলিম ছাত্রলীগের শক্তিতে পরিণত হয়েছেন, বঙ্গবন্ধু তার নিজের বয়ানেই তা তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে নতুন রাজনীতির পূর্বাভাস দিয়েছেন। রাজনৈতিক দলের নাম লিখিয়ে গতানুগতিক পকেট কমিটি ঘোষণা করে রাজনীতির বাইরে গণমানুষকে নিয়ে রাজনীতির স্বপ্নের কথা বলেছেন। যেখানে আদর্শ থাকবে, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড থাকবে, থাকবে সুনির্দিষ্ট অভীষ্ট। ব্রিটিশ রাজ্যের অধীনে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের কর্মী হয়েও সাত-সমুদ্দূর পারের ওপারের বেনিয়াদের বিরুদ্ধে অনল তার দাউ দাউ করে জ্বলছে।
১৯৩৭ সালের ১ এপ্রিল থেকে ১৯৪৩ সাল ২৯ মার্চ পর্যন্ত দু’দফায় অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শের-ই বাংলা ফজলুল হক। খাজা নাজিমুদ্দিন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ১৯৪৩ সালের ২৯ এপ্রিল থেকে ১৯৪৫ এর ৩১ মার্চ পর্যন্ত। এরপর প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণ করেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ১৯৪৬ সালের ২৩ এপ্রিল থেকে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত। তিনজন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ব্রিটিশ গভর্নরের ক্ষমতার আওতায় বাংলার প্রধানমন্ত্রী। অবিভক্ত বাংলার রাজধানী ছিল কোলকাতায়। প্রথম জন ছিলেন কৃষক প্রজা পার্টি থেকে। পরের দু’জন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মুসলিম লীগ থেকে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের জন্ম ২০২০ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায়। ১৯৩৮ সালে টুঙ্গিপাড়ায় আসেন প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন মিশন স্কুলের ছাত্র। স্কুল পরিদর্শনকালে কিশোর মুজিবের কথায় মুগ্ধ হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিনি তখন মুসলিম লীগের নেতা ও শেরে বাংলার মন্ত্রিপরিষদে শ্রমমন্ত্রী। মুজিব কোলকাতায় গেলে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। সেই থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দীর ভক্ত। কোলকাতায় কলেজে ভর্তির হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি মুসলিম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতির খুব কাছে চলে আসেন। শেখ মুজিবের আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, নেতার প্রতি অবিচল বিশ^াস সোহরাওয়ার্দীর আরও কাছাকাছি নিয়ে আসে।
মুসলিম লীগ তখন পর্যন্ত জমিদার, জোতদার, খান বাহাদুর আর নবাবদের প্রতিষ্ঠান ছিল। কেউ দলে আসতে চাইলেও তাকে নেওয়া হতো না। এই অভিজাত শ্রেণির রাজনীতিকে গণমানুষের রাজনীতিতে রূপান্তর করতে ১৯৪৩ সালটি একটি টার্নিং পয়েন্ট হয়ে ওঠে। একদিকে নবাব-বীরবাহাদুর-জোতদার নির্ভর মুসলিম লীগ থেকে খাজা নাজিমুদ্দিন প্রধানমন্ত্রী হন। অন্যদিকে মুসলিম লীগের মধ্যেই প্রগতিবাদী, উদার, গণতান্ত্রিক রাজনীতির উন্মেষ ঘটে। এই উদারপন্থী, গণতান্ত্রিক ও তারুণ্য দীপ্ত রাজনীতির কেন্দ্রে ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাসেম ও তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান।
শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, ‘১৯৪৩ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আরম্ভ হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছে। এই সময় আমি প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য হই। জনাব আবুল হাশিম সাহেব মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। তিনি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মনোনীত ছিলেন। আর খাজা নাজিমুদ্দিন সাহেবের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন খুলনার আবুল কাশেম সাহেব। হাশিম সাহেব তাকে পরাজিত করে সাধারণ সম্পাদক হন। এর পূর্বে সোহরাওয়ার্দী সাহেবই সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এই সময় থেকে মুসলিম লীগের দুইটা দল মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। একটি প্রগতিবাদী দল, আর একটি প্রতিক্রিয়াশীল। শহীদ সাহেবের নেতৃত্বে আমরা বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকের মুসলিম লীগকে জনগণের লীগে পরিণত করতে চাই, জনগণের প্রতিষ্ঠান করতে চাই। মুসলিম লীগ তখন পর্যন্ত জনগণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়নি। জমিদার, জোতদার ও খান বাহাদুর নবাবদের প্রতিষ্ঠান’।
এই ধারার ক্রমবিকাশেই ১৯৪৪ সালে কুষ্টিয়ায় শেখ মুজিব এক অগ্নি পরীক্ষার সম্মুখীন হন, একই সঙ্গে তরুণ মুজিবের প্রথম ‘পলিটিক্যাল ব্যাটল ফিল্ড’ হিসেবে পরিগণিত হয়। যেখানে তিনি উচ্ছৃঙ্খল তরুণ না হয়ে অপরাজনীতিকে নীতি দ্বারা পরাজিত করে সামনের রাজনৈতিক পথকে মসৃণ করেছিলেন। যেখানে তিনি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন। কোলকাতায় যে তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান গুরু সোহরাওয়ার্দীর সামনে মাথা তুলে কথা বলে গুরুর বকুনি খেয়েছিলেন সেই মুজিবই কুষ্টিয়ায় এসে সন্ত্রাসের জবাব দিলেন ধৈর্য আর সংযমতা দেখিয়ে। কুষ্টিয়ায় এসে তিনি এক পরিকল্পিত সন্ত্রাসের মুখোমুখি হন। সেদিন তিনি সন্ত্রাসের জবাব সন্ত্রাস বা কর্মী বাহিনীর পেশিশক্তি দিয়ে দিলে রাজনীতির গতিধারা অন্যরকম হতে পারত। কিন্তু হয়েছে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি এবং এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের অভিযাত্রা। তখনকার কালে মোবাইল ফোনের ব্যবস্থা থাকলে বা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যদি কাছে থাকতেন তিনি শেখ মুজিবকে সে উপদেশই দিতেন। গুরুর কথামতো আর গোলমালের পথে পা বাড়াননি।
শেখ মুজিব সে সময় চাচ্ছিলেন একটি গণতান্ত্রিক ধারায় মুসলিম ছাত্রলীগের নতুন নেতৃত্ব আসুক। অন্যদিকে ছাত্রলীগের উচ্চ পদে আসীন নেতারা চাচ্ছিলেন দীর্ঘদিন সম্মেলন না হলেও যারা নেতৃত্বে আছেন সবাই তাদের আস্থাভাজন; এ মুর্হূতে সম্মেলন জরুরি নয়। তরুণ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে কোলকাতাকেন্দ্রিক বাংলার যে মুসলিম যুবা-তরুণ রাজনীতিতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তারা চাচ্ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের নেতৃত্বের ছায়াতলে একটি নতুন ভ্যানগার্ড সংগঠন সংগঠিত হবে। যাদের নেতৃত্বে পাকিস্তান আন্দোলন ছড়িয়ে যাবে বাংলাজুড়ে। তরুণদের এই ধারাটি মুসলিম ছাত্রলীগ নেতৃত্বের মুখোমুখি হয়। ঘটনা আঁচ করতে পেরে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী দু’পক্ষকে এক জায়গায় বসিয়ে মিটমাট করে দিতে চাইলেন।
শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, ‘শহীদ সাহেব অবস্থা বুঝে আমাদের দুই দলের নেতৃবৃন্দকে ডাকলেন একটা মিটমাট করার জন্য। শেষ পর্যন্ত মিটমাট হয়নি। এ সময় শহীদ সাহেবের সঙ্গে আমার কথা কাটাকাটি হয়। তিনি আনোয়ার সাহেবকে একটি পদ দিতে বলেন, আমি বললাম কখনোই হতে পারে না। সে প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোটারি করেছে, ভালো কর্মীদের জায়গা দেয় না। কোনো হিসাব-নিকাশও কোনোদিন দাখিল করে না। শহীদ সাহেব হঠাৎ করে বলে বসলেন “Òwho are you” আমি বললাম “ if I am nobody, then why you have invited me? You have no right to insult me. I will prove that I am somebody, thank you sir. I will never come to you again”. এ কথা বলে চিৎকার করতে করতে বৈঠক ছেড়ে বের হয়ে এলাম। আমার সঙ্গে সঙ্গে নুরুদ্দিন, একরাম, নুরুল আলমও উঠে দাঁড়াল এবং শহীদ সাহেবের কথার প্রতিবাদ করল।
আমি তখন বিখ্যাত ৪০ নম্বর থিয়েটার রোড থেকে রাগ করে বেরিয়ে আসছিলাম। শহীদ সাহেব হুদা ভাইকে বললেন ‘ওকে ধরে আন।’ রাগে আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। হুদা ভাই দৌড়ে এসে আমাকে ধরে ফেললেন। শহীদ সাহেবও দোতলা থেকে আমাকে ডাকছেন ফিরে আসতে। আমাকে হুদা ভাই ডেকে আনলেন। বন্ধু-বান্ধবরা বলল, ‘শহীদ সাহেব ডাকছেন বেয়াদবি করো না, ফিরে এসো।’ উপরে এলাম। শহীদ সাহেব বললেন, ‘যাও তোমরা ইলেকশন কর, দেখ নিজেদের মধ্যে গোলমাল কর না’ আমাকে আদর করে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। বললেন, তুমি বোকা, আমি তো আর কাউকে এ কথা বলিনি। তোমাকে বেশি আদর ও স্নেহ করি বলে তোমাকে বলেছি।’ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তিনি সত্যি যে ভালোবাসতেন ও স্নেহ করতেন, তার প্রমাণ আমি পেয়েছি তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত।’
শেখ মুজিবুর রহমানের দাবি মতোই সম্মেলনের ব্যবস্থা হলো। কিন্তু তাকে দমানোর জন্য মুসলিম ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নতুন করে ষড়যন্ত্র আটতে থাকে। তারা জানে, ছাত্রলীগের কর্তৃত্ব সংগঠনের দুই নেতা আনোয়ার হোসেন ও নুরুদ্দিন সাহেবের হাতে। কিন্তু রাজধানী কোলকাতাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কোনো শক্তি নেই। কোলকাতায় ইসলামিয়া কলেজ কেন্দ্রিক কার্যক্রম আবর্তিত হয় শেখ মুজিবকে কেন্দ্র করে, কেন্দ্রীয় নেতারা নামেমাত্র। কোলকাতায় সম্মেলন ডাকলে পুরো নিয়ন্ত্রণ থাকবে শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে। মুজিব যে দিকে থাকবেন তার কথামতো তার দল নেতৃত্ব দখল করবে। আবার পূর্ব বাংলায় কোথায় সম্মেলন করবে সে রকম শক্তি পাচ্ছিল না নেতারা। পূর্ববাংলায় একমাত্র কর্মী শাহ আজিজুর রহমান যার ওপরে আনোয়ার হোসেনের আস্থা ছিল। শেষ পর্যন্ত তার ওপর ভরসা করেই কুষ্টিয়াতে সম্মেলন ডাকলেন। এ সময় প্রাদেশিক ছাত্রলীগের এই দুই নেতার মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়।
অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লিখেন, ‘আনোয়ার সাহেব কোলকাতায় ও ঢাকায় সম্মেলন করতে সাহস না পেয়ে কুষ্টিয়ায় শাহ আজিজুর রহমান সাহেবের নিজের জেলায় বার্ষিক প্রাদেশিক সম্মেলন ডাকলেন। ওই সময় আনোয়ার সাহেব ও নুরুদ্দিনের দলে ভীষণ গোলমাল শুরু হয়ে গেছে। আনোয়ার সাহেব আমার কাছে লোক পাঠালেন এবং অনুরোধ করলেন তার সঙ্গে এক হয়ে কাজ করতে। তিনি আমাকে পদের লোভ দেখালেন। আমি বললাম আমার পদের দরকার নাই। তবে সবার সঙ্গে আলোচনা করার দরকার। নুরুদ্দিন সাহেবের দলও আমার সঙ্গে আলাপ আলোচনা চালায়। একপক্ষ আমাকে নিতেই হবে, কারণ আমার এমন শক্তি কোলকাতা ছাড়া অন্য কোথাও ছিল না যে ইলেকশন করতে পারব।’
যেখানে সম্মেলন হোক, সমস্যা নেই। সম্মেলন হোক। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, গঠনতন্ত্র নির্দেশিত পথে, সবার অংশগ্রহণে একটি সম্মেলন হোক শেখ মুজিবুর রহমানের চাওয়া ছিল। আগের সম্মেলনে গঠিত কমিটি কার্যকর সময়ে কি করেছে সেখানে তার একটি জবাবদিহি করবে, আলোচনা হবে, বিচার বিশ্লষণ হবে, সফলতা-ব্যর্থতা আলোচনার মাধ্যমে করণীয় কৌশল নির্ধারণ হবে, আর্থিক কী লেনদেন হয়েছে সেগুলোও আলোচিত হবে- শেখ মুজিবুর রহমান এমন চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন ‘কোটারি’ বাদ দিয়ে, পকেটের লোক বাদ দিয়ে যোগ্য লোক দিয়ে কমিটি গঠিত হোক। এ জন্য খোলা মনের আলোচনা প্রয়োজন। নেতৃত্ব নির্ধারণ করবে কাউন্সিলররা। তাই সম্মেলন যেখানেই হোক তাতে তার আপত্তি ছিল না। সে বিষয়ে তার কোনো মতামতও নেই। নেতারা ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করবে কিন্তু তার সংগঠনের কাছে জবাবদিহি থাকতে হবে। সে জন্যই তিনি চেয়েছিলেন সম্মেলন হোক।
সিদ্ধান্ত মোতাবেক কুষ্টিয়ায় সিনেমা হলে সম্মেলনের প্রস্তুতি চলতে থাকে। সকল জেলার কাউন্সিলররাও এসে হাজির হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার আত্মজীবনীতে বলেন, ‘কুষ্টিয়ায় যখন আমরা পৌঁছালাম তখন দেখা গেল যত কাউন্সিলর এসেছে তার মধ্যে ৭০ ভাগ আমাদের সমর্থক। দুই দলের নেতৃবৃন্দের এক জায়গায় করে বসা হলো, উদ্দেশ্য আপস করা যায় কিনা? বগুড়ার আব্দুল বারীকে সভাপতি করে আলোচনা চলল। কথায় কথায় ঝগড়া হলো, তারপর মারামারি হলো, শাহ সাহেব অনেক গুন্ডা জোগাড় করে এনেছিলেন। আমরা বলেছিলাম, যদি গুন্ডামি করা হয় তবে কোলকাতায় তাকে থাকতে দেওয়া হবে না। শেষ পর্যন্ত আপস হলো না।’
যে দাবিতে এ সম্মেলনের প্রস্তুতি, যে উদ্দেশ্য নিয়ে সম্মেলন ডাকা তা আর সফল হতে দিল না, ষড়যন্ত্রই সেখানে পাখা মেলল। শাহ আজিজুর রহমানের ডেকে আনা অছাত্রদের দিয়ে সিনেমা হল দখল করে রাখা হলো, সত্যিকারের ছাত্রলীগ কাউন্সিলরদের ভোট দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হলো না। ছাত্ররা ভাড়াটে গুন্ডাদের বের করে দেওয়ার প্রতিবাদ করলেও সম্মেলনের সভাপতি হামুদুর রহমান সাহস না পেয়ে দাবির প্রতি কর্ণপাত না করে সভা চালিয়ে গেলেন। ছাত্রনেতা কামারুজ্জামান চিৎকার করে বললেন, ‘আমি জানি এরা অনেকেই ছাত্র না, বাইরের লোক। শাহ আজিজুর রহমান দল ভারি করার জন্য এদের এনেছে।’ শেষে সম্মেলনে উপস্থিত থাকা বেশির ভাগ ছাত্ররা গুন্ডামির বদলে সন্ত্রাসের পথে না গিয়ে সিদ্ধান্ত নিল এর জবাব কোলকাতাতে গিয়ে দেওয়া হবে।
এ সময় শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, ‘আমরা বাইরে লোকদের বের করে দিতে অনুরোধ করতে থাকলাম। ভীষণ চিৎকার শুরু হলো, আমরা দেখলাম মারপিট হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কয়েকজন বসে পরামর্শ করে আমাদের সমর্থকদের নিয়ে সভা ত্যাগ করলাম প্রতিবাদ করে। আমরা ইচ্ছা করলে আর একটা প্রতিষ্ঠান করতে পারতাম। প্রায় সমস্ত জেলায়ই আমাদের সমর্থক ছিল। তা করব না ঠিক করলাম, তবে কোলকাতায় এদের কোনো সভা করতে দেব না। কোলকাতায় মুসলিম ছাত্রলীগের নামেই আমরা কাজ করে যেতে লাগলাম। অল বেঙ্গল (অল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগ) ছাত্রনেতাদের কোনো স্থান ছিল না।’ এভাবে কুষ্টিয়া হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতি-যজ্ঞের পথ শুরুর ফলকে পরিণত হয়।
কুষ্টিয়া লোক সংস্কৃতির তীর্থভূমি। ধর্মীয় আচার আনুষ্ঠানিকতা ও মোহনার মতো মিশেছে ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায়। এ কুষ্টিয়ার শিলাইদহের অমর লোকগীতিকার গগণ চন্দ্র দাস বা গগণ হরকরা। ‘আমি কোথায় পাব তারে’ গানটির সুর-ছায়ায় রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন ‘আমার সোনার বাংলা’। সেই গানের অংশ বিশেষ বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দিয়ে কুষ্টিয়ার মানসকে সর্বোচ্চ তুলে ধরেছেন। একতারে মিলেছে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক অর্জনের অভিযাত্রা, আবহমান বাংলার ঐতিহ্য ও লোকগাঁথা।
লেখক : অর্থ সম্পাদক, কুষ্টিয়া সাংবাদিক ফোরাম ঢাকা।