গত দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে আমি একটু অসুস্থ। দৌঁড়াচ্ছি এটা সেটা টেস্ট, রিপোর্ট সংগ্রহ আর ডাক্তারের কাছে। এরই মাঝে হঠাৎ সকালে উঠে মুখ ধুতে গিয়ে দেখি আমার বাম চোখে রক্ত জমে আছে; যা রীতিমত আৎকে ওঠার মত!
কিছু স্পর্শকাতর অঙ্গ নিয়ে হেলাফেলা একেবারে মানায় না। বাড়ির কাছাকাছি ওএসবি চক্ষু হাসপাতাল। কালক্ষেপন না করে দুপুরে ৩০০ টাকার টিকেট কেটে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখালাম।ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ১৪ দিনের ৬৮০ টাকার ওষুধ কিনে নির্দেশনামত চলতে লাগলাম। ৩ দিনেও কোনো পরিবর্তন দেখছি না বরং আরো একটু বেশি জায়গা নিয়ে পুরো চোখের মণি পর্যন্ত রক্ত জমে গেছে।
ডাক্তার বলেছিলেন, চোখে ব্লাড বার্ন হচ্ছে। আর এটা সেরে উঠতে কমপক্ষে ৬ মাস লাগবে। ওষুধও ৬ মাসের জন্য দেয়া। কী ভয়ানক বিষয়! হঠাৎ করেই মনে পড়লো ‘জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে’ কর্তব্যরত ডাক্তার বন্ধু ইসমাইলের কথা।
তার রুমের সামনে গিয়ে ফোন করতেই রুম থেকে বেরিয়ে এসে স্বাগত জানিয়ে তার পাশেই বসতে দিয়ে খুব বিনয়ের সাথে রোগী দেখার অনুমতি চেয়ে শুরু করল একের পর এক রোগী দেখা। আমি ২ ঘণ্টা বসে ছিলাম। একটুও বিরক্ত লাগেনি আমার।
যা দেখলাম- ডাক্তার ইসমাইল হোসেন একজন শিক্ষানবিশকে সাথে নিয়ে রোগী দেখছিলেন ।সে তার ছাত্রটিকে যে ভাবে কাজ শেখাচ্ছিলেন; তা ছিল আমার চোখে একজন বাবা ও মেয়ের ছবির মত। প্রত্যোক রোগীকে আগে দেখছেন স্টুডেন্ট।তার কাছে রোগীর রোগ সম্পর্কে জানতে চাইছেন।কোন রোগের জন্য কী কী ইনভেস্টিগেশন, অবজারভেশন, ব্যবস্থাপত্র কী হবে সব শেখাচ্ছেন।
শুধু দাপ্তরিক দায়িত্বই পালন করছেন না একই সাথে শেখাচ্ছেন নৈতিকতাও। সে তার ছাত্রীকে বলছেন, টাকা জমাবে না। আয় করা টাকায় আধুনিক ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কিনবে। যেন রোগীর সেবায় কোথাও কোনো কমতি না থাকে।
এমন একজন শিক্ষক কয়জন আছে আমাদের দেশে? চারিদিকে শুনি, ডাক্তার হলো কসাই।
অথচ তিনি সকাল ৮টা থেকে রোগী দেখা শুরু করেছেন। শেষ করেছেন দুপুর ২.৩৫টায়। প্রায় ৫০ জন রোগী দেখেছেন। করোনার ভয় নেই! প্রত্যেক রোগীর কাছে গিয়ে তার কপালে, চোয়ালে, মাথায় হাত দিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ভীষণ আন্তরিকতার সাথে এবং হাসি মুখে রোগী দেখছেন।
কিছুক্ষণ পর পর হাত স্যানিটাইজড হচ্ছেন। মনে হচ্ছিল রোগী ডাক্তারের বন্ধুসুলভ আচরণে অর্ধেকটাই সুস্থ হয়ে গেছেন। এজন্যই শিক্ষকতা, ডাক্তারি পেশাসহ বেশ কিছু পেশাকে সেবামূলক পেশা বলে। ডাক্তার ইসমাইল হোসেন একজন যথার্থই সেবক।
তিনি তার ছাত্র ছাত্রীদেরকেও এভাবেই গড়ছেন।যারা ভবিষ্যতে কাজে ফাঁকি না দিয়ে একজন সৎ, আন্তরিক, সময়নিষ্ঠ, দায়িত্বসচেতন ও পেশাদারিত্ব মনোভাব নিয়ে হয়ে উঠবেন আদর্শ ডাক্তার তথা মানবসেবক। হাসপাতাল আর ঔষধ প্রশাসনে এতো দুর্নীতি অনিয়ম তাতে হাসপাতালগুলো অচল হয়ে যাবার কথা। হয়নি, হবেও না। কেনো না সংখ্যায় খুব অল্প হলেও ভালো মানুষ এখনও আছেন। আর ভালো মানুষ আছেন বলেই সমাজ টিকে আছে।
আমরা প্রত্যেকেই যে যে পেশাতেই থাকি না কেনো নিজে যদি সৎ হই, দায়িত্ব সচেতন হই, অন্যের প্রাপ্য ঠিকমত বুঝিয়ে দেই, সময়কে সদ্ব্যবহার করি এবং আন্তরিকতার সাথে কাজ করি তাহলে সোনার বাংলার স্বপ্ন সফল হতে সময় খুব বেশি লাগবে না।
সমাজ বদলে ভালো কাজের প্রতি ব্যক্তির সদ্বিচ্ছাই যথেষ্ট।
লেখক : শিক্ষক ও আবৃত্তিশিল্পী।