সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৩৯ অপরাহ্ন

শতবর্ষী সবচেয়ে পুরনো ব্যাংক খোকসায়, যা জুবিলী ব্যাংক লিমিটেড নামে পরিচিত

এ্যাড: সিরাজ প্রামাণিক / ৭১০ বার নিউজটি পড়া হয়েছে
আপডেট টাইম: বৃহস্পতিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২০, ৫:৫৯ অপরাহ্ন

ব্যাংকিং পদ্ধতির উন্মেষ ঘটে মধ্যযুগ এবং রেনেসাঁর শুরুতে। বিশেষ করে সাধারণ মানুষের সঞ্চয় সংগ্রহ করে পুঁজি গড়ে তোলে এবং সেই পুঁজি উদ্যোক্তাদের ধার দিয়ে বিনিয়োগে সাহায্য, আন্তর্জাতিক লেন-দেন, অর্থনৈতিক চালিকা শক্তির উন্মেষ ঘটাতেই ব্যাংক ধারণার উদ্ভব ঘটে। এ উপমহাদেশে নীল বিদ্রোহের পর পরই ইংরেজ শাসন আমলে ব্যবসা বিস্তার ও সম্প্রসারণ করতে খোকসা অঞ্চলের মানুষ একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯১৩ সালে খোকসার প্রাণকেন্দ্রে প্রমত্তা গড়াই নদীর পাড়ে প্রতিষ্ঠা পায় ‘খোকসা জানিপুর জুবিলী ব্যাংক লিমিটেড’। যা ওই বছরেরই ১৫ এপ্রিল যৌথ মূলধন কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত হয়। মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর আরজেএসসিতে নিবন্ধিত হয়ে নিবন্ধন নম্বর পান- সি-২৩৭৩।

ভারত বর্ষের কোম্পানি আইন অনুসারে সোনা, গহনা ও জমি বন্ধকের বিনিময়ে ব্যবসা শুরু করে ব্যাংকটি। পরবর্তীতে মানুষের ব্যবহার্য্য মূল্যবান সামগ্রী বন্ধকী পরিচালনার সীমাবদ্ধতা রেখে মাত্র একটি শাখার মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। ১৯৮২ সালের ১৫ এপ্রিল প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে যাত্রা শুরু করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৭০ বছর সমবায় ব্যাংক হিসেবে পরিচালিত হবার পর ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকের লাইসেন্স প্রদান করে। এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৮৭ সালে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘জুবিলী ব্যাংক লিমিটেড’। এখনও বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে ব্যাংকটিতে অ-তফসিলি ব্যাংক ঘোষনা করে কার্যক্রম চালু রেখেছে। পরবর্তী সময় স্বর্ণ বন্ধকের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কুটির শিল্প ও চাষিদের সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয় এই ব্যাংকটিকে। এটি দেশের অ-তফসিলি (নন-সিডিউল) পাঁচটি ব্যাংকের একটি।

দেশের বেসরকারি খাতের সবচেয়ে পুরোনো জুবিলী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মুন্সি বিপ্লব ইসলামকে আদালতের নির্দেশনার আলোকে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক অপসারণ করেন। একই সঙ্গে ব্যাংকটিতে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে নিয়োগ দেন। নতুন চেয়ারম্যান দায়িত্ব নিয়ে দ্রুততম সময়ে ব্যাংকটির স্থগিত থাকা সব বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) সম্পন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এর পূর্বে মালিকানার দ্বন্ধসহ বিভিন্ন কারণে দীর্ঘদিন ধরে জুবিলী ব্যাংকের এজিএম অনুষ্ঠিত হচ্ছিল না। ২০১২ সালে এজিএম করা নিয়ে ব্যাংকটির পরিচালক মো. শহীদুল্লাহ হাইকোর্টে একটি মামলা করেন। মামলার আদেশে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের জন্য তিন সদস্যের প্যানেল করে তাদের আবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকে দাখিল করতে নির্দেশ দেন আদালত। তবে তা না করে সরাসরি এমডি নিয়োগ দেওয়ায় চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানসহ সাত জনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা হয়। মামলার শুনানি শেষে আদালত অবমাননার দায়ে তাঁদের সাজা দেন আদালত। সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে তৎকালীন চেয়ারম্যান এমবিআই মুন্সী ও ভাইস চেয়ারম্যান মো. মনিরুজ্জামানকে এক দিনের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একজন সদস্য অনুপস্থিত থাকায় তাঁকেও এক দিনের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া ব্যাংক চার পরিচালককে কিছু সময় আদালত কক্ষে দাঁড়িয়ে থাকার দণ্ড এবং অপর এক নারী সদস্য অসুস্থ থাকায় তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

ফ্রিডম পার্টির কয়েকজন নেতার নামে এ ব্যাংকটির শেয়ার থাকায় কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে ব্যাংকটি। ব্যাংকিং আইন অনুযায়ী দণ্ডপ্রাপ্তরা চেয়ারম্যান বা পরিচালক থাকতে পারেন না। এর আগে মুনাফা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় জুবিলী ব্যাংকের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে খোলা হিসাব বন্ধের আবেদন করেন রফিকুল আলম, রিদওয়ানুল বারি মুনীর ও মো. শহীদ উল্লাহ নামে জুবিলী ব্যাংকের তিন শেয়ারহোল্ডার। এ ব্যাংকটি খুলনার দৌলতপুর, ঢাকা মতিঝিল ও খোকসা জানিপুরে তিনটি শাখা থাকলেও বর্তমান খোকসায় একটি মাত্র কার্যালয়ে কার্যক্রম চলছে এ ব্যাংকটির। এটিই প্রধান শাখা হিসেবে পরিচিত।

তবে একটি গ্রুপ আছে যারা অনেকদিন ধরেই ব্যাংকের ক্ষতি করার জন্য ঝামেলা করছে। ফ্রিডম পার্টির কিছু সদস্য এক সময় এ ব্যাংকের শেয়ার হোল্ডার ছিলেন। ৩০ থেকে ৪০ বছর আগে থেকেই তাদের শেয়ার ছিল। অবশ্য ব্যাংকের বোর্ড তাদের এই শেয়ার অবৈধ ঘোষণা করেছে। এর ফলে তাদের শেয়ার কেউ কিনতে পারবে না। বিক্রি করতেও পারবে না। আপাতত এই শেয়ার ব্যাংকের এ্যাসেট হয়ে থাকবে। তবে সরকার ইচ্ছে করলে এই শেয়ার জব্দ করে হস্তান্তর করতে পারবে।

ব্যাংকটির বর্তমানে আমানতকারী দুই হাজার এবং ঋণ নিয়েছে ৭০০ জন। ১৯৮২ সাল থেকে খুলনায় ব্যাংকটির আরেকটি শাখা থাকলেও ২০০০ সালের পরে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ব্যাংকটি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে যখন লাইসেন্স নেয়, তখন মিয়া আবদুর রশীদ নামে এক ব্যক্তি এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সে সময় তার হাতে ব্যাংকের শেয়ার ছিল ৫১ শতাংশ। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তিনিই ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি মৃত্যুর পরে তার নাতী ব্যারিস্টার এমবিআই মুন্সী ২০০২ সালে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ২০০৮ সালে তিনি আবারও এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান পুননির্বাচিত হন। বর্তমানে এ ব্যাংকটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম।

এ ব্যাংকটিতে দীর্ঘদিন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এম.ডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন খোকসার বিশিষ্ট দানবীর, শিক্ষানুরাগী ও ব্যবসায়িক সাফল্য ব্যক্তিত্ব হাজী জালাল মিঞা এবং ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত পরিচালক (ডাইরেক্টর) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন খোকসার আরেক গুনিজন জনাব মোন্তাজ আলী প্রামাণিক। ব্যাংকটির উন্নয়নে এ দুজনের অবদান অপরিসীম।

লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা, সম্পাদক প্রকাশক-‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’ ও খোকসার সন্তান। মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮


আপনার মতামত লিখুন :

Comments are closed.

এ জাতীয় আরো খবর...
এক ক্লিকে বিভাগের খবর