বাংলাদেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প গঙ্গা কপোতাক্ষ‘র (জিকে) ভেড়ামারার তিনটি সেচ পাম্পই অকেজো হওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে পানি সরবরাহ। এতে চলতি বোরো মৌসুমে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা জেলার সেচ প্রকল্পাধীন এলাকার বিশ হাজার হেক্টর জমিতে ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যহত হচ্ছে। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা।সেই সাথে চলতি মৌসুমে কাঙ্ক্ষিত দেড় লক্ষ মেট্রিক টোন ধান উৎপাদন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কৃষকেরা সেচ প্রকল্পের পানি কবে থেকে পাবেন তার কোনো সঠিক তথ্য দিতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।বর্তমানে পানি শুন্যতায় মাঠের পর মাঠ ফেটে চৌচির।
পরিস্থিতির উন্নতি না হলে খাদ্য শস্য উৎপাদন ব্যহত হওয়ার পাশাপাশি এসব কৃষক পরিবার জীবন ধারণে সংকটে পড়ার আশংকায় রয়েছে।
দ্রুত সমস্যা সমাধানের দাবী করছে চাষীরা। তারা সেচ সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় নিজেদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে অবিলম্বে সেচ সরবরাহ চালুর দাবি করেছেন।এদিকে সেচ প্রকল্প মেরামত ও বিকল্প ব্যবস্থপনায় সমস্যা সমাধানের কথা জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
অন্যদিকে খাদ্য শস্য উৎপাদন অব্যহত রাখতে ভু-গর্ভস্থ পানি ব্যবহারের পরামর্শ কৃষি বিভাগের। যদিও ভূ-গর্ভ’স্থ পানির স্তরও নিচে নেমে গেছে।
সেচ প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, পদ্মায় পানির স্তর স্বাভাবিক থাকলে একেকটি পাম্প প্রতি সেকেন্ডে গড়ে ২৮ হাজার ৩১৬ দশমিক ৮৫ লিটার পানি সরবরাহ করতে পারে। মোট তিনটি পাম্পের মধ্যে ৩ ও ২ নম্বর পাম্প দুটি গত ২০১৭ ও ২০২১ সালে থেকে অকেজো।
১৯৬২ সালে এই প্রকল্পের মাধ্যমে পদ্মা নদী থেকে চ্যানেলের মাধ্যমে পানি এনে পাম্প করে সরবরাহ খালের মাধ্যমে ৪ জেলার ১৩টি উপজেলায় সরবরাহ করা হয়।
প্রকল্পের আওতায় সেচযোগ্য এলাকা রয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ১০৭ হেক্টর। শুরুতে বছরের ১০ মাস (১৫ জানুয়ারি থেকে ১৫ অক্টোবর) দিনরাত ২৪ ঘণ্টা ৩টি পাম্পের মাধ্যমে পানি তোলা হতো। বাঁকি দুই মাস চলত রক্ষণাবেক্ষণ।
এই প্রকল্পে ১৯৩ কিলোমিটার প্রধান খাল, ৪৬৭ কিলোমিটার শাখা খাল ও ৯৯৫ কিলোমিটার প্রশাখা খাল রয়েছে।
এসব খালের মাধ্যমে সেচ প্রকল্পের পানি কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা জেলার কৃষকরা ব্যবহার করে চাষাবাদ করতো। সেচ প্রকল্পের পানি না পেয়ে বর্তমানে শ্যালো মেশিনের সাহায্যে সেচ বাবদ প্রতি বিঘায় খরচ বেড়েছে ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার। স্বল্প খরচের সেচব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন ৩০ থেকে ৩৫ গুণ বেশি খরচ করে শ্যালো মেশিনের সাহায্যে বিভিন্ন ফসলের জমিতে সেচ দিচ্ছেন কৃষকরা।
এদিকে সেচ প্রকল্পের খালে পানি থাকলে সেচের পাশাপাশি আশপাশের নলকূপ ও পুকুরে পানি স্বাভাবিক থাকে। কিন্ত এমন অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে নলকূপে পানি পাওয়া নাও যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে যার নমুনা ইতিমধ্যেই লক্ষ করা যাচ্ছে।
চলতি বছর ১লা ফেব্রুয়ারিতে ১ নম্বর পাম্প চালু করে পানি ছাড়া হয়। কিন্তু ১৯ দিন পরে সর্বশেষ সচল পাম্পটিও অকেজো হয়ে গেছে। পানির অভাবে অনেক কৃষক ধান লাগাতে পারছেন না, কারও ধানের জমি শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে। আবার কেউ কেউ শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে বিকল্প সেচের ব্যবস্থা করেছেন।
কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) প্রকল্পের পাম্প ইনচার্জ মিজানুর রহমান বলেন, দুটি পাম্প আগে থেকেই নষ্ট ছিল। তৃতীয় পাম্প দিয়ে ১লা জানুয়ারি ক্যানেলে পানি সরবরাহ শুরু হয়। কারিগরি ত্রুটির মুখে ১৯ ফেব্রুয়ারীতে তৃতীয় পাম্পটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কবে নাগাদ সেচ কার্যক্রম চালু করা যাবে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
মিজানুর রহমান আরও বলেন, মেনটেনেন্স বাবদ প্রতিবছর ৫০ থেকে ৭০ লাখ টাকা খরচ হয়। গত বছর ৫৯ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।
প্রকল্পের উপপ্রধান সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আবদুল বাতেন বলেন, এই সময়ে পদ্মায় পানি কম থাকায় দুটি জেলার পানি সরবরাহ হয়ে থাকে। বর্তমানে পানি সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। কবে নাগাদ পাম্প চালু হবে, সেটাও বলা যাচ্ছেনা।
কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার জোতমোড়া গ্রামের কৃষক বিল্লাল হোসেন ও আমিরুল ইসলাম বলেন, সেচখালে পানি না থাকায় চারা দিতে পারছিনা। পিয়াজ আবাদের পর ঐ জমিতে প্রতি বছর ধান আবাদ করা হলেও এবার হয় তো আর ধান আবাদ হবেনা। ভুট্টা রোপনের সময়ও শেষ।
সদর উপজেলার জগতি গ্রামের চাষী শমসের আলী’র অভিযোগ, খালে পানি না আসায় চাষাবাদে চরম সমস্যায় আছি। স্যালোতে পানি উঠছেনা, যে দুই/একটিতে একটু উঠছে তাও হাফ পরিমান। জমি পতিত থাকলে ক্ষতি হবে।
চাষী বাবুল হোসেন বলেন,পানি ছাড়া কোন ফসলই হচ্ছেনা, জিকে কর্তৃপক্ষ আগে যদি জানাতো পানি দিতে পারবেনা, তাহলে আমরা আগেই অন্য ব্যবস্থা করতাম।
খোকসার উপজেলাপর কৃষক আরমান শেখ জানান, পানির আশায় থেকে অন্য ফসল আবাদ করিনি। আবার ধানও রোপন করতে পারলাম না। এসব কৃষকেরা খালে পানি সরবরাহের জোর দাবী করেন।
কুষ্টিয়ার উপপরিচালক সুফি মোঃ রফিকুজ্জামান জানান, চলতি বোরো মৌসুমে জেলাতে ৩৬ হাজার হেক্টর জমিতে ধান উৎপাদনের লক্ষমাত্রা নির্ধারন করা হয়। কিন্তু এবছর জিকে সেচ প্রকল্পের সেচ সরবরাহ বন্ধ থাকায় সেচ এলাকাধীন বিশ হাজার হেক্টর জমিতে ধান উৎপাদন ব্যহত হবে। এতে ৭৭ হাজার মেঃ টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ঘাটতির শংকা থাকবে প্রবল। তবে পরবর্তী আমন মৌসুমে এই ঘাটতি পুষিয়ে নেয়ার কথা জানালেন তিনি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়ার সেচ সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তা আব্দুল মতিন জানান, বোরো মৌসুমে কুষ্টিয়াসহ ৪ জেলার সেচ সরবরাহ আওয়তাধীন ৯৫ হাজার ৬শ ১৬ হেক্টর জমির মধ্যে ২০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সরবরাহ করা হতো। কিন্তু‘ এবছর উল্লেখিত বিশ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করতে চাইলে চাষীদেরই অন্যকোন বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ রশিদুর রহামান জানান, দেশের বৃহৎ এই সেচ প্রকল্পটি মেরামত ও পূর্ননির্মান করে চালু করতে প্রকল্প গ্রহন ও প্লানিং কমিশনে প্রেরণ করা হয়েছে। এই উন্নয়ন প্রকল্পটি যাচাই বাছাই শেষে অনুমোদন পেলেই কাজ শুরু হবে। একই সাথে তিনি বলেন, বিদ্যমান সেচ সংকট থেকে কৃষকদের মুক্ত করতে বিকল্প ব্যবস্থার কথাও ভাবছে সরকার।
বর্তমানে প্রকল্পের আওতায় ৯৫ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব ছিল। দুটি মেশিন আগে থেকে নষ্ট থাকায় চলতি বোরো মৌসুমে সর্বো”চ ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার সক্ষমতা ছিল প্রকল্পের। অবশেষে শেষ পাম্পটি নষ্ট হওয়ায় এবার সেই লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হলো না।
বাংলাদেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প গঙ্গা কপোতাক্ষ‘র (জিকে) ভেড়ামারার ফাইল বন্দি প্রকল্পটি দ্রুত অনুমোদন এখন সময়ের দাবী। প্রকল্প বাস্তবায়নই এই সংকট মোকাবেলার একমাত্র উপায় বলে মনে করছেন ভুক্তভোগী ৪ জেলার কয়েক হাজার কৃষক।