মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:১৬ অপরাহ্ন

সুফি ফারুকের দৃষ্টিতে হেফাজত…

সুফি ফারুক ইবনে আবুবকর / ৪৪৯ বার নিউজটি পড়া হয়েছে
আপডেট টাইম: বৃহস্পতিবার, ১ এপ্রিল, ২০২১, ৩:৫১ অপরাহ্ন

হেফাজত এ ইসলাম ২০১৩ সাথে ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। তাদের বক্তব্য ছিল-বাংলাদেশ একটি মুসলিম রাষ্ট্র, কিন্তু ইসলামি রাষ্ট্র নয়৷ ইসলামি শাসন কায়েমের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত হবে৷ তারা ইসলামি দলগুলোকে এক করে নির্বাচনে প্রার্থী চেয়েছিল৷ তারা জানিয়েছিলে ইসলামি শাসন কায়েমই হবে তাদের উদ্দেশ্য৷ আর ইসলামি শাসন কায়েম হলে দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধী দলীয় নেত্রী কোনও নারী হতে পারবেন না ৷

পরিস্থিতির কারণে সেই অবস্থানে তারা না থাকতে পারলেও, বিগত বছরগুলোতে ওয়াজ মহফিলের মাধ্যমে তারা, ইসলামি রাষ্ট্র ও ইসলামি শাসনতন্ত্রের পক্ষে জনমত গঠনে সক্রিয় ছিল। বিভিন্ন ওয়াজের ভিডিওতে, তাদের বক্তাদের ইসলামিক রাষ্ট্রের গুণগান ও প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করতে দেখা গেছে। তারা বলতে চান সমাজের সুদ, ঘুষ, ধর্ষণ, দুর্নীতি সহ সব সমস্যার সমাধান একমাত্র ইসলামিক রাষ্ট্র কায়েমের মাধ্যমে সম্ভব।

ইহুদি নাসারাদের আবিষ্কারের করা ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের কারণে আজকের বাংলাদেশের অবস্থা এতটা খারাপ। তাদের দাবি শরিয়া আইন ছাড়া সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা, সুখ ও সমৃদ্ধির কোনো সুযোগ নেই। তারা নিয়মিত ঘোষণা করে গণতন্ত্র হারাম ও গণতন্ত্রের মাধ্যমে মানুষের তৈরি আইন হারাম। তারা তরুণদের সামনে গণতন্ত্রের বিপরীতে ইসলামিক বা শরিয়া রাষ্ট্রের স্বপ্নটাকে রাখছে। তারা তরুণদের অনুরোধ করছে যেন তরুণরা এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জেহাদে উদ্বুদ্ধ হয়।

অপরদিকে প্রগতিশীল মুসলিমরা বলার চেষ্টা করেন ইসলামিক রাষ্ট্রের সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলামিক রাষ্ট্র বলে ইসলামের ইতিহাসে কিছু ছিল না। রসুলুল্লাহ (সা:) মদিনা সনদের মাধ্যমে শাসন ক্ষমতা পান। সেই মদিনা সনদ ছিল একটি সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ সনদ। কারণ সেই সনদে সই করা পক্ষগুলোর সবাই মুসলিম ছিল না। তারা মহান আল্লাহ এবং তার প্রেরিত রসুল হিসেবে রসুল্লাহকে তখন মানত না। কিন্তু রসুলুল্লাহ (সা:) তার উন্নত চরিত্র, বুদ্ধিমত্তা এবং প্রজ্ঞার কারণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলেন। সেই কারণেই তারা মদিনা সনদের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতা দেন। রসুলুল্লাহ (সা:) এর পরে খেলাফতে রাশেদা তার ধারাবাহিকতা। কিন্তু সেই ধারাবাহিকতা বিভিন্ন বিপথগামীদের সৃষ্টি করা ফেতনায় নষ্ট হয়। এরপর থেকে যা চলেছে তা রাজতন্ত্র। সেই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানগণ মুসলিম ছিলেন এবং কিছু সিদ্ধান্ত আলেমদের মতে করা হয়েছে এটুকুই, এর বাইরে তাতে ইসলামিক কিছু নেই।

আবার সেই রাজতন্ত্রও অনেক সময় সেকুলার রাষ্ট্রের মতো পরিচালনা করতে বাধ্য হয়েছে। সুতরাং মুসলিমদের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় “ইসলামিক রাষ্ট্র” ১৯ শতকের আগে কোথাও ছিল না। পাকিস্তানই প্রথম ইসলামিক রাষ্ট্র। আর সেই রাষ্ট্রের বর্তমান দশা দেখলেই বোঝা যায় যে এই নতুন থিওরির ইসলামিক রাষ্ট্র কেমন হতে পারে। এর সাথে ইসলামকে সম্পৃক্ত করলে ইসলামকে খাটো করা হয়।

এই বিতর্ক বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই বিতর্ক আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। পক্ষে বিপক্ষে ভাগ হয়ে নেটিজেনরা বিভিন্ন ধরণের বিতর্ক করছে। তবে সেই বিতর্কে যুক্তি ও রেফারেন্সের বদলে অশ্রাব্য ভাষার প্রয়োগই বেশি। এমতাবস্থায় বিগত ৩০ মার্চ রাত ৯.০৩ মিনিটে, তথ্য প্রযুক্তিবিদ সুফি ফারুক ইবনে আবুবকর, তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে, ৮টি প্রশ্নের মাধ্যমে, হেফাজতের আলেমদের কথিত ইসলামিক রাষ্ট্রকে, কোরআন হাদিস ও বাস্তবতার আলোকে যৌক্তিক প্রমাণ করার চ্যালেঞ্জ করেছেন। প্রশ্নগুলোর উত্তরসহ সঠিক রূপরেখা প্রণয়ন করতে পারলে তিনিও হেফাজতে যোগ দেবেন। আর হেফাজত যদি সেটা না পারে তবে তাদের মাফ চেয়ে আন্দোলন প্রত্যাহার করতে হবে। স্ট্যাটাসটি প্রচুর কপি, শেয়ার ও নানারকম বিতর্কের পরে আমাদের নজরে আসে।

একজন মুমিন না জেনে বুঝে কিছুর মধ্যে লাফ দিতে পারে না। মুসলিম এর জন্য আল্লাহ ইকরা [পড়া], তাদাব্বুর [গভীর চিন্তা ] তাফাক্কুর [ধ্যান করা] ফরজ করেছেন। সেটি না মানলে কুরআনের অনুসরণকারী হিসেবে নিজেকে দাবি করা যায় না।

তাই আমি অত্যন্ত বিনীত ভাবে হেফাজত-এ-ইসলাম এর আলেমদের আমার কিছু প্রশ্নের “পূর্ণ ও স্পষ্ট” জবাব দেবার আহবান করছি।

আপনাদের উত্তরের মাধ্যমে আমি বুঝতে চাই – আপনারা আসলে কি করতে চাইছেন? কেন করতে চাইছেন? সেটা কতটুকু ইসলামিক? সেটা কতটা যৌক্তিক ও যুগোপযোগী? সেটি আদৌ বাস্তবায়নযোগ্য কি না?

১. আপনারা যে ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চান, সেখানে বাংলাদেশের সকল ধারার মুসলিম [তাদের আকিদা, আমল] কিভাবে সমন্বয় [Accommodate] করবেন? সব ধারার মধ্যে যেহেতু ভিন্নতা আছে, তাই কাদের মতাদর্শ প্রধান গুরুত্ব পাবে? পরপর অন্যদের কিভাবে সমন্বয় করবেন?

২. সংবিধান কুরআন [আশা রাখি আপনাদের দ্বিমত নেই] । তবে তার সাথে বর্তমান জাতিরাষ্ট্রের সকল অপরিহার্য সংবিধানের ধারা [ যেগুলো কোরানে স্পষ্ট নেই], সেগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবেন। সেগুলো পূরণ না করতে পারলে তো এখন রাষ্ট্র গঠন বা পরিচালনা করতে পারবো না।

৩. রাষ্ট্রের আইন প্রণেতা, আইন ব্যাখ্যাকারী ও আইন প্রয়োগকারীদের নির্বাচন ও নিয়োগের নিয়ম জানাবেন। তাদের পদে থাকার সময়কাল ও পুন-নির্বাচনের পদ্ধতি উল্লেখ করবেন।

৪. জাতিসংঘের সাথে যুক্ত হবার শর্ত ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কনভেনশন এর শর্তগুলোর বিষয়ে স্পষ্ট মতামত দেবেন।

৫. আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থার সাথে কিভাবে যুক্ত হবেন তা স্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করবেন।

৬. বিজ্ঞান- প্রযুক্তি শিক্ষা ও গবেষণার সীমা স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করবেন।

৭. অন্য ধর্মে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের সম অধিকার বিষয়ে আপনাদের নীতি জানাবেন।

৮. এরকম মডেল বর্তমানে বিশ্বের কোন দেশে আছে উল্লেখ করবেন।

আপনাদেরকে আগামী ৭ দিনের মধ্যে, এই লেখার নিচে, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে বিনীত ভাবে অনুরোধ করছি। ততক্ষণ পর্যন্ত দয়া করে আন্দোলন বন্ধ রাখেন। কারণ না জেনে আন্দোলন করা যাবে না।”

তাদের বিভিন্ন বক্তৃতায় যা শুনেছি তাতে তাদের প্রস্তাবিত “ইসলামিক রাষ্ট্রের” সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক নেই কোনো বাস্তবতার। তারা অতীতের বিভিন্ন গৌরবময় গল্প করে, তরুণদের এক ধরণের ঘোরের মধ্যে নিয়ে, তাদেরকে দিয়ে একটি দু:স্বপ্ন কায়েম করার স্বপ্ন দেখছে। তারা এসবের মাধ্যমে তরুণদের মনে আমাদের রাষ্ট্র, সংবিধান, পতাকা, জাতীর পিতা, জাতীয় সঙ্গীত বিষয়ে বিষবাষ্প ঢোকাচ্ছে। তাদেরকে একটি কল্পিত মরীচিকার দিকে ডাকছে।

যে রাষ্ট্রের আসলে কোনো বাস্তবতা নেই, সেটার স্বপ্ন বিক্রি এক ধরণের আত্মপ্রতারণা এবং তরুণদের বিপথে নিয়ে যাবার একটি বিরাট ষড়যন্ত্র। দেশে দেশে তাদের মতো এ ধরনের বিভ্রান্তিমুলক প্রচারণার কারণে আমরা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো ইসলামিক আদর্শে সবচেয়ে পিছিয়ে। আন্তর্জাতিক আলেম ও একাডেমিশিয়ানদের সমন্বয়ে পরিচালিত ইসলামসিটি ইনডেক্সে সার্ভেতে আমরা কি দেখলাম? বেশিরভাগ ইহুদি নাসারাদের স্কেনডিনেভিয়ান দেশগুলো ইসলামিক মূল্যবোধের বাস্তবায়নে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে। আমাদের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর সবচেয়ে নিচের দিকে। আমি একজন তালেব এ ইলম, আলেম নই।

কিন্তু একজন মুসলিম হিসেবে আমার বাকি সব মুসলিম ভাই বোনদের ভালো মন্দ দেখাকে আমি ফরজ মনে করি। আমি আলেমদের কাছে একান্তে প্রশ্নগুলো করে কোনো সন্তোষজনক জবাব না পেয়ে বুঝতে পেরেছি তারা আসলে জবাব দিতে চায় না। কারণ জবাব দিতে গেলেই তাদের চিন্তার দৈত্য জনসমক্ষে দেখা যাবে। আমি বিবেকের তাড়না থেকে এই প্রশ্নগুলো পাবলিক করে দিয়েছি। দেখি কি উত্তর আসে। তার পরে এই বিষয়ে আবার বলব”।

লেখক : প্রযু‌ক্তি‌বিদ


আপনার মতামত লিখুন :

Comments are closed.

এ জাতীয় আরো খবর...
এক ক্লিকে বিভাগের খবর