টুঙ্গিপাড়ার খোকা থেকে বিশ্ব নেতা শেখ মুজিব।
বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা। বাঙালি থেকে বাঙালির জাতীয়তাবাদের জনক।গোপালগঞ্জের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়েও হয়ে যান বাঙালির ভাগ্য নির্মাতা।
আদর্শে অবিচল, নীতি ও সততার প্রশ্নে আপোষহীন এবং বাঙালির প্রশ্নে যিনি শর্তহীন তিনিই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালির জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ছোট বেলায় হোস্টেলের ছাঁদ ঠিক করার অর্থের জন্য রাস্তা অবরোধ করে দাঁড়ান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথিকৃত সোহরাওয়ার্দী সাহেব সেদিনেই চিনে নেন বাঙালির মুক্তির দূতকে। পরম স্নেহ, মমতা আর নিজের আদর্শে গড়ে তোলেন শেখ মুজিবুর রহমানকে। ছোট থেকেই সততা, স্পষ্টবাদিতা আদর্শ, সুদূরপ্রসারী চিন্তা ভাবনা ও নেতৃত্বের দক্ষতা সবার কাছেই শেখ মুজিবকে প্রিয় করে তোলে।
কলকাতার ইসলামীয়া কলেজে পড়াশোনার সময় কলকাতা মহানগরের ছাত্রনেতা হিসেবে পরিচিত শেখ মুজিব জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা প্রতিরোধে। ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তরুণ শেখ মুজিব।
বিভক্তির পরে দেশে ফিরে পিতার স্বপ্ন পূরণের জন্য ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আিইন বিভাগে। পিতা শেখ লুৎফর রহমানের স্বপ্ন ছিল তার সন্তান “ল” ডিগ্রি নিয়ে বড় এডভোকেট হবে। তাই তিনি শেখ মুজিবকে একবার বলেছিলেনও প্রয়োজনে কিছু জমি বিক্রি করে টাকা দেই তুমি বিলেতে গিয়ে আইনে ডিগ্রি নিয়ে আসো।
সাত কোটি বাঙালিকে অন্যায়ের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিতে পারলেও শেখ মুজিব পারেন নি তার পিতার স্বপ্ন পূরণ করতে।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী অগ্নিশিখা যার রক্তে,
সে কি করে অন্যায় দেখে চুপ থাকে!
শেখ মুজিব ও পারেন নি। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের বিরুদ্ধে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদে দূর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেন। ফলাফল ঢাবির তৎকালীন প্রশাসন বাঙালির বরপুত্রকে না চিনতে পেরে বহিস্কার করেন।
শেখ মুজিব বুঝতে পারেন, “বাঙালির মুক্তি মেলে নি।”
তাই গড়ে তুলেন “ছাত্রলীগ” নামের একটি ছাত্রসংগঠন। শেখ মুজিবের নির্দেশে ইতিহাসের পরতে পরতে যে সংগঠনের নেতাকর্মীদের রক্তে তৈরী হয়েছে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের দেয়াল। ১৯৪৮ সালের সফল ভাষা অান্দোলন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন। এখানে আমরা শেখ মুজিবুর রহমানের স্পষ্টবাদীতার প্রমাণ পাই। বর্তমান সময়ে কর্মীরা যেখানে নতজানু, নেতার সামনে মাথা নিচু করে পা চাটে! শেখ মুজিব সেখানে মাথা উঁচু করে নেতার ভুল সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন।
যুক্তফ্রন্ট গঠনে শেখ মুজিবুর রহমানের মত ছিলো না। তখন মুজিব জেলে থাকায় তার প্রতিবাদ ও করতে পারেন নি। জেল থেকে বের হয়েই পাকিস্তানে ছুটে যান সোহরাওয়ার্দীর কাছে। একদিন পরে দেখা করতে যাওয়ায় সোহরাওয়ার্দী বলেন, গতকাল আসলে না কেন? তোমার গতকালকেই আশা উচিত ছিলো। প্রতিউত্তরে শেখ মুজিব বলেন, এসে কি করব? আপনি তো যুক্তফ্রন্ট গঠন করেই ফেলেছেন? ভাবছি, সারাজীবন আপনাকে নেতা মেনে ভুলই করলাম কি-না! উত্তরে সোহরাওয়ার্দী বলেন,বুঝতে পেরেছি, আর বলতে হবে না। তুমি কাল এসো, কথা আছে।
সবাই যেখানে মন্ত্রীত্ব নিয়ে টাকার পাহাড় গড়ে তোলে শেখ মুজিব সেখানে বলেন, আমি মন্ত্রিত্ব নিবো না, দলের অনেক কাজ বাকি!
কোন ধরনের উচ্চাকাঙ্খা,লোভ-লালসা যাকে কোনদিন স্পর্শ করতে পারে নি, তিনিই তো হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি।
এরপর, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, চৌষট্টির হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি, ছেষট্টি সালের ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে বিজয়, ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা, অসহযোগ অান্দোলন,১৯৭১-র সাত মার্চে উর্ধ্বমুখী তর্জনীর গর্জন, ত্রিশ লক্ষ বাঙালির প্রাণ, দুইলক্ষ নারীর সম্ভ্রম, এক সাগর রক্ত, এরপর ৫৬ হাজার বর্গমাইলের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র।
কথাগুলো খুব সহজে বলা গেলেও এই পথ এতটা সহজ ছিলো না, ছিলো কণ্টকাকীর্ণ আর বারুদের ঝাঁঝালো গন্ধে ভরা। প্রতি পদক্ষেপে ছিলো মৃত্যুর ফাঁদ। তবুও শেখ মুজিব আপোষ করেন নি, বাঙালির ভালবাসা তাকে আপোষ করতে দেয় নি। তাইতো পাকিস্তান কারাগার থেকে বলেছিলেন, তোরা যদি আমাকে মেরে ফেলিস তাহলে আমার লাশটা আমার বাঙালির কাছে পাঠিয়ে দিস।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব বলেছিলেন,” আমার শক্তি, আমি আমার বাঙালিদের ভালবাসি। আমার দূর্বলতা, আমি তাদের খুব বেশি ভালবাসি”।
এই ভালবাসাই তাকে বানিয়েছে নেতা থেকে পিতা। সোনালী যৌবনের ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাগারে থেকেও যিনি কোনদিন বাঙালির প্রশ্নে আপোষ করেন নি, তিনিই তো জাতীর পিতা।তাইতো একজন বাঙালি হিসেবে “শেখ মুজিব আমার পিতা”।
১৯৭২ সালে দেশে ফিরেই মনোযোগ দেন দেশ গঠনে। পরাজিত শক্তি তাকে বেশিদিন বাঁচতে দেয় নি। তবে খুব অল্পদিনেই পাল্টে দিয়েছিলেন ধ্বংস্তূপের বাংলাদেশ কে।
বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে “রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা, বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র নির্মাণ এবং মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানোর চিন্তা জাতির পিতার দূরদর্শী ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বিণির্মানের স্বপ্নের প্রমাণ দেয় যা হয়ত সহ্য হয় নি পরাজিত শক্তি ও তাদের দোসরদের। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র এবং এ উর্বর ভূমিতে জন্ম নেওয়া কিছু হায়েনার সহযোগিতায় অকালেই প্রাণ দিতে হয় উন্নত ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশের এই স্বপ্নদ্রষ্ঠাকে। কিন্তু যার স্থান মানুষের হৃদয়ের মনিকোঠায়, সাধ্য আছে কার তাকে হত্যা করার! তাইতো জাতির পিতা মরে গিয়েও বেঁচে আছেন কোটি মানুষের হৃদয়ে। তিনি বেঁচে থাকবেন স্বপ্নের সোনার বাংলায়।
“যতদিন রবে, পদ্মা, মেঘনা যমুনা গোরী বহমান,
ততদিন রবে কৃর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।
লেখাঃ জাফর ইকবাল
শিক্ষার্থী, সরকারি বাঙলা কলেজ।