** সিদ্ধান্ত স্কুলের মাঠ হয়ে গেছে গ্যারেজ ওয়ার্কশপ দোকান ** দখলদাররা বেপরোয়া **
রাজধানীর অন্যতম বৃহৎ মিরপুরের শত বছরের পুরনো একটি স্কুলের খেলার মাঠ দখল হয়ে গেছে। মিরপুর মাজার রোড প্রথম কলোনি বাতেন নগর এলাকার এই সম্পত্তি মিরপুর সিদ্ধান্ত হাই স্কুলের মাঠ হিসেবে পরিচিত। অনেকে চিনেন গাবতলী পুরনো মাঠ নামেও। তবে এক দশকে মাঠের পরিচিতি হারিয়ে সেখানে গড়ে উঠেছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। চলছে দখলদারি, ভাড়া বাণিজ্য। এসবের আড়ালে আবডালে চলে গাঁজা সেবন। কয়েক’শ কোটি টাকার সম্পত্তি এই মাঠের ভেতরে নির্মাণ করা হয়েছে গাড়ির ওয়ার্কশপ, গ্যারেজ, বহুতল ভবন ও দোকান। সামনে মার্কেট বানিয়ে দোকান ভাড়া দেয়া হয়েছে। এসব থেকে মাসে নিয়মিত আদায় হচ্ছে কয়েক লাখ টাকা। স্কুল কর্তৃপক্ষ দখলদারদের দাপটের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে। ১০ বছর আগে বেদখল হওয়া ৬ একর সম্পত্তির এই মাঠ ফিরে পেতে তারা দৌড়াচ্ছেন জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতাদের কাছে। কোথাও সাড়া না পেয়ে গেছেন আদালতে। কিন্তু দখলদাররা এরও তোয়াক্কা করছে না। তারা বেপরোয়া।
স্থানীয়রা জানান, ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯১৬ সালে সিদ্ধান্ত স্কুল প্রতিষ্ঠার পর থেকে মাঠটি উন্মুক্ত ছিল। সেখানে নিয়মিত খেলাধুলা চলত। বছরের বিভিন্ন সময় উৎসবকে ঘিরে বসত মেলা। ফুটবল মাঠ হিসেবে পরিচিত হলেও সময় পরিক্রমায় ক্রিকেটও জায়গা করে নেয় সেখানে। মাঠে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলা চলে পাশাপাশি। হতো নেট প্র্যাকটিসও। কিন্তু গত এক দশক আগে মাঠের চারপাশ ঘিরে ধীরে ধীরে দখলদারি শুরু হলে ক্রীড়ামোদিরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। মাজার রোড প্রথম ও দ্বিতীয় কলোনি, লালকুঠি, সিএন্ডবি, টোলারবাগ, বর্ধনবাড়িসহ বেশ কয়েকটি এলাকার ছেলেদের খেলার পাশাপাশি চারপাশের লোকজনের হাঁটাচলা বন্ধ হলে দখলদারদের সঙ্গে স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরোধ বাধে।
দাবি করা হয়, জমিদারের ওয়ারিশরা ওয়াক্ফ এস্টেটের সম্পত্তি রক্ষা করছেন। বিরোধের এক পর্যায়ে তৎকালীন সাংসদ আসলামুল হক মাঠের জমির মূল্য নির্ধারণ করে দুই পক্ষের মধ্যে ভাগাভাগির উদ্যোগ নিয়ে একাধিক বৈঠক করেন। স্কুল পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে একরকম দফারফা হলেও স্থানীয়রা বাধ সাধেন। এরপর তা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু দখলদারি বাড়তেই থাকে। দখলদাররা তৎকালীন সাংসদের নিকটাত্মীয় হওয়ায় স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয়রা থমকে যান। আসলামুল হকের মৃত্যুর পর স্কুল কর্তৃপক্ষ মাঠটি উদ্ধারের ব্যাপারে ফের আশায় বুক বেঁধেছেন।
সরজমিনে দেখা যায়, মিরপুর রোড ধরে শাহ আলী মাজার রোডের প্রথম কলোনির পথ ধরে হাঁটতেই রাস্তার পূর্বপাশে বাতেননগরে এক সময়ের বিশালাকৃতির খেলার মাঠটি এখন অচেনা রূপ নিয়েছে। স্কুলের মাঠ লেখা সাইনবোর্ড খুলে ফেলা হয়েছে। ৬ বিঘা জমির মাঠের মধ্যে এখন প্রায় এক বিঘা ফাঁকা রয়েছে। সেখানে সামান্য বৃষ্টিতে পানি জমে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। ঘাস না থাকায় জমা পানিতে কাদায় একাকার হয়। এটুকু দখল করতে এ যেন পরিকল্পিত জলাবদ্ধতা। এছাড়া চারপাশে হোন্ডা গ্যারেজ, সিমেন্ট গোডাউন, মবিল দোকান, চা দোকান, গাড়ি ওয়ার্কশপ ও গ্যারেজ ছাড়াও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিস বসিয়ে ভাড়া তোলা হচ্ছে। নেয়া হয়েছে এডভান্সও। মাঠের ভেতর খালি অংশে রাখা হচ্ছে মিনি ট্রাক, পিকআপ, লেগুনা।
বাতেননগরের একাধিক ভবন মালিক জানান, মাঠের সৌন্দর্যের কারণেই বাড়তি প্রাপ্তি হিসেবে তারা জমি কিনে বাড়ি করেছিলেন। নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াও মাঠের পূর্বকোণে আবাসিক এলাকার মাদ্রাসা ও মসজিদ রয়েছে। বাচ্চাদের খেলাধুলার জায়গাটি চোখের সামনে দখল করা হয়েছে। হারিয়ে গেছে সবুজ ঘাস। খেলার মাঠটি উদ্ধারে স্থানীয় বাড়ি মালিকরা মানববন্ধন করেন। কিন্তু আসলামুল হকের প্রভাব খাটিয়ে তার স্বজনরা মাঠের চারপাশে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তুলে ভাড়া তুলছেন। ওয়াকফ এস্টেটের নামে চলছে দখলদারি। মাঠে খেলাধুলা বন্ধ থাকায় অভিভাবকরা দারুণভাবে হতাশ হয়েছেন।
মাঠে খেলাধুলা করেন এমন একাধিক যুবক জানান, পূর্বপাশ থেকে ধীরে ধীরে দখল করা হয়েছে। ১০ বছরে অস্তিত্ব হারিয়েছে মাঠ। এখন সেখানে শর্টপিচ ক্রিকেট ও মিনিবারে ফুটবল খেলা যায়। অথচ আগে সেখানে বড় বড় টুর্নামেন্ট হতো। চারপাশে দাঁড়াতেন কয়েক হাজার দর্শক। ডে-নাইট পৃথক ম্যাচ হতো। ওই মাঠের একজন ফুটবল ট্রেইনার (পঞ্চাশোর্ধ) জানান, সবই হচ্ছে গায়ের জোরে। খেলার মাঠটি শেষ করে দেয়া হয়েছে। সবাই শুধু দেখেন, ভয় পান। যেন কারো কিছু করার নেই।
মিরপুর সিদ্ধান্ত হাই স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মুজিব সারোয়ার মাসুম বলেন, স্কুলের শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা করবে এবং স্থানীয়রা গবাদিপশু চড়াবে- এমন শর্তে ব্রিটিশ আমলে জমিদার মুন্সী লাল মিয়া ৬ বিঘা জমির ওই মাঠটি স্কুলকে দান করেন। জমিদারের নামে করা জমিদার মুন্সী লাল মিয়া ওয়াক্ফ এস্টেটের নামে তার উত্তরাধিকারদের অনেকে এখন এসব সম্পত্তি দখল নিয়েছেন। এ নিয়ে তারা মামলা করেছেন উল্লেখ করে মাসুম বলেন, দখলদাররা প্রয়াত সাংসদ আসলামুল হকের আত্মীয়। আসলাম এমপি থাকাকালে মাঠ বেদখল হয়। তখন তারা মামলায় একতরফা একটি রায় করিয়ে নেয়। স্কুল পরিচালনা পর্ষদ জানতে পেরে আপিল করেছে।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম রনি জানান, তিনি ২০১৬ সালে স্কুলে যোগদান করেছেন। তার আগেই মাঠটি বেদখল হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে ভাড়া নিচ্ছে লোকজন। স্কুলের জন্য মাঠটি দরকার দাবি করে তিনি বলেন, আসলামুল হকের ভয়ে এতদিন স্কুল কর্তৃপক্ষ নীরব ছিল। দখলের প্রতিবাদ করায় তাকে চাকরিচ্যুত করার হুমকি দেয়া হয়।
তিনি জানান, জমিদার দানপত্রে উল্লেখ করেন, সেখানে সকালে গরু চড়বে আর বিকালে শিক্ষার্থীরা খেলাখুলা করবে। এর দলিল স্কুলে সংরক্ষিত রয়েছে। যার সূত্রে স্কুলের পক্ষ থেকে মাঠ উদ্ধারে মামলা করা হয়েছে। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি রনি বলেন, এখন আসলামুল হক নেই। অবৈধ প্রভাব খাটবে না। স্কুল কর্তৃপক্ষ তার মাঠ ফেরত পেতে চায়। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান উচ্ছেদ করে মাঠ খেলার উপযোগী করতে চান।
আসলামের ভাগ্নে জাহাঙ্গীর হোসেন বাবলা জমিদার মুন্সী লাল মিয়া ওয়াকফ এস্টেটের মোতোয়াল্লি। তিনি এসব দখলদারির নেতৃত্বে আছেন। এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীর হোসেন বাবলার সঙ্গে মোবাইলফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, জমিদার স্কুলকে এই জমি দান করেননি। এর বেশি কোনো কথা বলতে রাজি হননি তিনি। পরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি এড়িয়ে গেছেন।