কুষ্টিয়া শহরের পাঁচ রাস্তার মোড়ে রাতের আঁধারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার ঘটনায় জড়িত মাদরাসার দুই ছাত্র এবং এই ঘটনায় মদদ দেয়ার অভিযোগে ওই মাদরাসার দুই শিক্ষককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
গ্রেফতার দুই মাদরাসাছাত্র পুলিশকে জানিয়েছেন, ইসলামি বক্তা মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হক ও ফয়জুল করিমের বয়ান শুনে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুর করেন।
এর আগে শুক্রবার (৪ ডিসেম্বর) দিবাগত রাতের কোনো এক সময় কুষ্টিয়া শহরের পাঁচ রাস্তার মোড়ে পৌরসভার উদ্যোগে প্রায় ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের মুখ ও হাতের অংশ ভাঙচুর করেন তারা। পরে অভিযান চালিয়ে শনিবার (৫ ডিসেম্বর) রাতে প্রথমে মাদরাসার দুই শিক্ষক এবং পরে তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে রোববার ভোরে ওই দুই ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতাররা হচ্ছেন-কুষ্টিয়া শহরের জুগিয়া পশ্চিমপাড়া ইবনে মাস্উদ (রা.) মাদরাসার হেফজ বিভাগের ছাত্র আবু বক্কর ওরফে মিঠুন (১৯) ও সবুজ ইসলাম ওরফে নাহিদ (২০) এবং শিক্ষক আল-আমিন (২৭) ও ইউসুফ আলী (২৬)।
মিঠুন কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার শিংপুর মৃধাপাড়া এলাকার সমসের মৃধার ছেলে এবং সবুজ দৌলতপুর উপজেলার ফিলিপনগর গোলাবাড়িয়া এলাকার সামছুল আলমের ছেলে।
গ্রেফতার শিক্ষক আল-আমিন কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার ধুবইল গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে এবং ইউসুফ আলী পাবনা জেলার আমিনপুর থানার দিয়াড় বামুন্দি গ্রামের আজিজুল মণ্ডলের ছেলে।
রোববার (৬ ডিসেম্বর) বিকেল পৌনে ৪টার দিকে কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন্সে এক সংবাদ সম্মেলনে খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার মহিউদ্দিন সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান।
এ সময় অতিরিক্ত ডিআইজি এ কে এম নাহিদুল ইসলাম, কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার এসএম তানভীর আরাফাতসহ পুলিশের অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি বলেন, ‘স্পর্শকাতর এ ঘটনা ঘটার পর সিসিটিভি ফুটেজ এবং প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে পুলিশের সব ইউনিটকে কাজে লাগানো হয়। ২৩ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ হামলায় অংশ নেয়া দুজন এবং তাদের মদদ দেয়া দুই শিক্ষককে আটক করতে সক্ষম হয়েছে।’
তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘দেশের বিরুদ্ধে এবং দেশের রাষ্ট্রীয় সম্পদের ওপর যে বা যারা আঘাত হানবে তাদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। এ ঘটনার পেছনে কারা আছে, কারা ইন্ধন দিয়েছে, নেপথ্যে কেউ জড়িত কি-না পুলিশ সেসব বিষয়ও খতিয়ে দেখছে।’
সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, অভিযান পরিচালনাকালে কুষ্টিয়া মডেল থানার অধীন জুগিয়া পশ্চিমপাড়া মাদরাসা ইবনে মাসউদের (রা.) জামাত বিভাগের ছাত্র আব্দুল্লাহ (১৫) এবং আব্দুর রহমানকে (১৭) আটকপূর্বক জিজ্ঞাসাবাদ ও ভিডিও ফুটেজ দেখালে তারা তথ্য দেয় যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভাঙচুরকারী দুজনকে তারা জানে। তারা একই মাদরাসার হেফজ বিভাগে পড়াশোনা করেন।
পরবর্তীতে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে আবু বক্কর ওরফে মিঠুন এবং একই মাদরাসার ছাত্র সবুজ ইসলাম ওরফে নাহিদকে তাদের নিজ নিজ গ্রাম থেকে রোববার গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেন। মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হক ও ফয়জুল করিমের বয়ানে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা এ ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে জানান।
তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, শনিবার রাত ২টা ৫ মিনিটের সময় যখন মাদরাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়েন, তখন তারা দুজনে গোপনে মাদরাসা থেকে বের হয়ে হেঁটে শাহীন কাউন্সিলরের বাসার সামনে দিয়ে কানাবিল মোড় পার হন। এরপর কমলাপুর হয়ে মজমপুর রেললাইন ধরে ফজলুল উলুম মাদরাসার পাশ দিয়ে পাঁচ রাস্তার মোড়ে ভাস্কর্যের কাছে আসেন। তারপর ভাস্কর্য নির্মাণকাজে ব্যবহৃত বাঁশের মই দিয়ে উপরে উঠে নাহিদুল ইসলামের ব্যাগ থেকে হাতুড়ি বের করে আবু বকর মিঠুন ও সবুজ ইসলাম দুজন মিলে রাত ২টা ৫ মিনিট থেকে রাত ২টা ১৩ মিনিট পর্যন্তু নির্মাণাধীন ভাস্কর্যটির বিভিন্ন জায়গায় হাতুড়ি দিয়ে জোরে আঘাত করেন। ভাস্কর্যটির ক্ষতিসাধন করে পুনরায় হেঁটে মাদরাসায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন।
সকালে মাদরাসার শিক্ষক আল-আমিন ও ইউসুফ আলীকে তারা ভাস্কর্য ভাঙচুরের বিষয়টি জানালে দুজনই তাদের মাদরাসা থেকে দ্রুত পালিয়ে যেতে বলেন। পরে আসামিদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে ওই দুই শিক্ষককে মাদরাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়।
এ ঘটনায় কুষ্টিয়া মডেল থানায় মামলা করা হয়েছে। মামলা নম্বর ৮।
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ নিয়ে দেশব্যাপী ইসলামপন্থী বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিবাদের মধ্যেই কুষ্টিয়ায় এ ঘটনা ঘটল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভাঙার এ ঘটনায় কুষ্টিয়াসহ দেশব্যাপী তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে।