টেলিভিশন হলো তথ্য-বিনোদনের বিস্ময়জাগানিয়া মাধ্যম। যেখানে একইসঙ্গে দেখা যায় ছবি, শোনা যায় শব্দ। আবার কথাও বলতে পারেন সাধারণে-‘টক শো’ কিংবা ‘ফোনো লাইভে।’ বলা যেতেই পারে যে-টেলিভিশনই প্রথম বিশ্বকে ঘরের মধ্যে এনেছিল-১৯২৬ সালে। আর দিনটি ছিল ২১ নভেম্বর। তাই আজ বিশ্ব টেলিভিশন দিবস।
টিভির আবিষ্কারক জন লোগি বেয়ার্ড। বিজ্ঞানী জন লোগি বেয়ার্ড-এর টেলিভিশন আবিষ্কারের দিনটি ছিলো ২১ নভেম্বর। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ১৯৯৬ সালে জাতিসংঘ আয়োজিত ফোরামে ২১ নভেম্বর বিশ্ব টেলিভিশন দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
রুশ বংশোদ্ভুত প্রকৌশলী আইজাক শোয়েনবার্গের কৃতিত্বে ১৯৩৬ সালে প্রথম টিভি সম্প্রচার শুরু করে ব্রিটিশ ব্র্রডকাস্টিং করপোরেশন-বিবিসি। টেলিভিশন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চালু হয় ১৯৪০ এ। তার আগে ঘটে যাওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরিবর্তন এসেছিল মানুষের বহুমাত্রিক মানসিকতায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাই টেলিভিশনের পরম্পরা উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠে। যদিও বিশ্বজুড়ে টেলিভিশন গণমাধ্যমের ভূমিকায় উঠে আসে গত শতাব্দীর ৫০ এর দশকে। আর আমাদের দেশে টিভির বিবর্তন আসে ১৯৬৪ সালে। সে বছরের ২৫ ডিসেম্বর সাদা-কালো সম্প্রচার শুরু হয়েছিল। তখন একটা উন্মাদনাও এসেছিল সাংস্কৃতিক জাগরণে। পুরণো যাঁরা আছেন তাঁদের কাছে সেসব দিনের টিভি দেখা কেবলই পারস্পরিক স্মৃতি রোমন্থনে নিষ্ক্রান্ত নয়, পরম আনন্দের আধেয়রূপে দোলা দেয়।
বাংলাদেশে টেলিভিশনের রঙিন সম্প্রচার শুরু ১৯৮০ সালে। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অসহায়ের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে একুশ শতকে গোটাবিশ্বে টেলিভিশনই সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে অদ্যবধি ভূমিকা রাখছে। একই পরম্পরায় বাংলাদেশেও হালফিলের গণমাধ্যম ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে। বিগত বছরে-বিভিন্ন সময়ে এবং চলমান আবর্তনে বেসরকারি টিভি প্রশংসনীয় হয়েছে জনতার জয় হিসেবে। সম্প্রতি টিভি মালিকেরা মিলে সংগঠন গড়েছেন। এ্যাটকো নামের সংগঠনটিও টিভির ভুত ভবিষ্যত নিয়ে কাজ করছে। সেসব বিবেচনায় ঘুরে দাঁড়ানোর নয়া স্বপ্নও অনেকটা আশাজাগানিয়া।
উদাহরণ টেনে বলতেই পারি-একুশে টেলিভিশনের সার্বিকতা। এদেশের প্রথম বেসরকারি টেরিস্ট্ররিয়াল টিভি একুশে। হাজারো উৎরাই পেরিয়ে এখনো অবিকল। সার্বজনীন এবং স্বীকৃত গণবান্ধব বিশেষায়িত এই টিভি চ্যানেল। শুদ্ধচিন্তা, মুক্তবুদ্ধি, জাতির জনকের আদর্শ আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে এগিয়ে চলা একুশের মধ্য দিয়ে নবজাগৃতি ঘটেছে বাঙালি সংস্কৃতির। পরিবর্তনে অঙ্গিকারবদ্ধ একুশে টিভি মুক্তচিন্তার খোলা জানালা-জাগোজনতার প্ল্যাটফরম।
একুশে টিভির শুভযাত্রা ২০০০ সালের ১৪ এপ্রিল। বাঙালিপ্রাণে যেদিন ছিল পহেলা বোশেখের বর্ণিল আমেজ। আর তখনই নতুন শতকের সম্ভাবনার বহুমাত্রিক সূর বেজে ওঠে শুদ্ধ মানুষের বিশুদ্ধ বিবেকে। তথ্যপ্রবাহের অবাধ দুয়ার খোলার নেপথ্যে যিনি ছিলেন তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একুশের পাল তুলে একুশে টিভির উদ্বোধন করেছিলেন তিনি। সেই থেকে সম্ভাবনার অপার স্রোত দোলা দিতে থাকে বাঙালির নবপ্রাণে। জাগে বাংলাদেশ, জাগতে থাকে জনতা। একুশে টিভির মাধ্যমে উঠে আসে আপামর মানুষের অন্তর্লীণ কথা। ধ্বনিত হয় রূপসা থেকে পাথুরিয়া, টেকনাফ হতে তেঁতুলিয়ার সরসকণ্ঠ। একুশের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে যোগ হয় ভিন্ন মাত্রা।বহুমাত্রিক বিনোদনে প্রধান হয়ে ওঠে হাজার বছরের বাঙালিসংস্কৃতি। মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়নের অভিযাত্রায় একুশে অল্পদিনে হয়ে ওঠে চেতনার অমর একুশ। শুদ্ধতার সে প্রবহমানতা এখনো অবিচল-অব্যাহত।
রুচিশীল বিনোদন, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে প্রগতির যাত্রিকতা, যুদ্ধাপরাধি-জঙ্গীদের প্রতিহত করে বহুমাত্রিক অনুষ্ঠানে নিবিষ্ট করতে মানুষের সঙ্গে মানুষের সঙ্গ গড়ে দেয় একুশে টেলিভিশন। একইসঙ্গে সংবাদপ্রচারে আপোষহীনতার নীতিও বজায় রাখে। তাতে যেমন থাকে অনিবার্যতা তেমনি স্বপ্নের দ্বৈরথে এগিয়ে চলে একুশে টিভি। বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে ২০০২ সালের ২৯ শে আগস্ট বন্ধ হয়ে যায় কোটি মানুষের ভালোবাসার একুশে। ২০০৬ সালের ১লা ডিসেম্বর আদালতের রায়ের পর ২০০৭ সালে নতুন শক্তিতে বলিয়ান হয়ে আবারও সম্প্রচারে আসে একুশে টেলিভিশন। সেই থেকে অদ্যবধি দুর্বৃত্তদের ষড়যন্ত্র আর নানান ঘাত-প্রতিঘাত ডিঙিয়ে এগিয়ে চলেছে জনতার একুশে। একুশ মানে মাথা নত না করা আর একুশে টিভি মুক্তচিন্তার খোলা জানালা। দুইয়ের সম্মিলনে একুশে এখনো অবিনশ্বর।
বাংলাদেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো নানান ধরণের সমস্যায় আক্রান্ত। বাণিজ্যিক নীতি নির্ধারণ না হওয়ায় বিজ্ঞাপন নিয়ে চলছে কাড়াকাড়ি। নির্দিষ্ট যে বাজার ছিল তাও চলে যাচ্ছে অনলাইন প্ল্যাটফরমে। বর্তমানে ৩০টি স্যাটেলাইট চ্যানেল বিদ্যমান। রয়েছে ২টি রাষ্ট্রীয় চ্যানেল। আর্থিক দৈন্যদশা বেসরকারি টিভিগুলোর নিত্যসঙ্গী। প্রতিনিয়ত চলছে কর্মীছাঁটাই। মাসের পর মাস বকেয়া পড়ে যাচ্ছে। বেশ ক’টি চ্যানেল তাদের বার্তাকক্ষ বন্ধ করে দিয়েছে। আবার অন-এয়ারের অপেক্ষায় থাকা কিছু চ্যানেলে বার্তাকক্ষই নেই। বেতন অনিয়মিত, নাই ইনক্রিমেন্ট, নাই বিজ্ঞাপন। নাই ভালো বাণিজ্যিক নীতি। এমনকি এই বাতায়নে ভবিষ্যত দেখার চিন্তাটাও ধুলিস্যাত আপাতত। ভিন্ন জানালায় দেখলে, বহুজনের নিরপেক্ষতা এবং চেতনাও বিশেষভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। তারা কেউই ভালো কন্টেন্ট দিতে পারছে না।
ব্যাপক অর্থে যদি বলি – নাই ভালো নাগরিক শো, নাই ভাল নাটক, নাই ভালো সিনেমা, নাই ভালো আড্ডা অনুষ্ঠান ৷ চতুর্পাশে নাই,নাই আর নাই। এই ‘নাই’য়ে ভরা চলমানতায় আবার হয়তো কেউ কেউ ঘুরে দাঁড়াবে। টিভি মিডিয়ায় উচ্চারিত হবে মুক্তিযুদ্ধের জয়গান, বাঙালি আবারও সতেজ হবে সম্প্রীতি-মৈত্রী আর সরস মেলবন্ধনে। কারণটা এতোদিন ধোঁয়াশাচ্ছন্ন থাকলেও এখন অনেকটাই প্রকট এবং পরিষ্কার। যে সময়টা আমরা পার করছি তাতে বেশ জোরেশোরেই ভর করেছে মৌলবাদিতা। ধর্মের নামে খুন হচ্ছে মানুষ। পূণ্যের আশায় পোড়ানো হচ্ছে বাড়িঘর। সর্বোপরি হিংসার আগুনে জ্বলছে দেশ, জ্বলছে সংস্কৃতি। এভাবে চলতে থাকলে ভুলুণ্ঠিত হবে স্বাধীনতার চেতনা, ভবিষ্যতের ঐক্য। মানুষ রক্ষায় তাই মানুষের মেলবন্ধন অতিব জরুরী। আর সেই কাজটিই করবে টেলিভিশন তথা সম্প্রচার মাধ্যম। সুতরাং আমরা আশায় বুক বাঁধি, স্বপ্ন দেখি-এবং স্বপ্ন দিয়ে তাড়াতে চাই দু:স্বপ্ন।
বেসরকারি টিভিগুলোর চারপাশে অনেক ‘নাই’ এর মধ্যে শীঘ্রই আরো ১১টি চ্যানেল সম্প্রচারে আসছে। ফলে বেসরকারি চ্যানেলের সংখ্যা দাঁড়াবে ৪১টিতে। টেলিভিশন মার্কেটের যে অবস্থা তাতে নতুন চ্যানেল ততোধিক সংকট বাড়বে। পুরনো টিভিই যেখানে ধুঁকপুক করছে সেখানে নতুন স্টেশন আদৌ স্বকীয়তা তৈরি করবে কি না তা-ও ভাবার প্রসঙ্গ হতে পারে।
সুতরাং বিশ্ব টেলিভিশন দিবসে সমসাময়িক সমস্যাগুলো সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য। এমনকি বৈশ্বিক গণমাধ্যমেওে এখন খরা চলছে। বিবিসি, সিএনএন থেকে হালের জনপ্রিয় অনেক স্টেশন পুরণো নীতি থেকে সরে এসেছে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বিবিসিতে কর্মী ছাঁটাইয়ের খবরটি সামনে আসে। ওয়ার্ল্ড সার্ভিস, রেডিও ও বিবিসি লাইভ থেকে প্রায় হাজারখানেক সংবাদকর্মী ছাঁটাইয়ের খবরটি ফাঁস হয় ভিক্টোরিয়া ডার্বিশায়ারের বিবিসি টু অনুষ্ঠানে। আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের কর্মী ছাঁটাই ঘটা করে খবর হয়েছে দুনিয়াজুড়ে। তারপরও বলি, দৈনন্দিন খবর জানতে ও মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে টেলিভিশন যন্ত্রটি বিশ্বব্যাপী এখনও ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। কম্পিউটার ও স্মার্টফোন এসে বিনোদন ও খবর পরিবেশনের ক্ষেত্রে টেলিভিশনের জায়গা অনেকখানি দখল করে নিয়েছে।তারপরও আশা দেখি, অনলাইন কোনো ব্যত্যয় ঘটাবে না মূল কনটেন্টের।
প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অসহায়ের কন্ঠস্বর হিসেবে সারাবিশ্বে টেলিভিশনকেই সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়। একুশ শতকে প্রযুক্তির উৎকর্ষ ও সময়ের দাবিতে বাংলাদেশেও টিভি মাধ্যম ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। প্রতিদিনের খবরাখবর ও মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে এখনো টেলিভিশনের গুরুত্ব যারপরনাই অপরিসীম।
বাড়িয়ে বলি, টেলিভিশন এখন শুধু ড্রয়িং রুমের বিনোদন নয়। সোশ্যাল মিডিয়াতেও মানুষ উপভোগ করেন টিভির বিচিত্র কন্টেন্ট। ইউটিউব লাইভ ফিড এখন দর্শকের সবচেয়ে বড় আগ্রহের ব্যাপার। আবার এও ঠিক যে, টিভি মিডিয়ায় যে সংখ্যক দর্শক থিতু হয়েছে তা শুধু নিউজ চ্যানেলের কল্যাণেই।
চারপাশের উন্নয়ন, সমস্যা আর সম্ভাবনার সাথে গণমানুষের সেতুবন্ধন গড়ে তুলবে টেলিভিশন। সর্বোপরি দর্শকের সঙ্গে টিভি স্টেশনের নৈকট্য বাড়াতে হবে। আমরা স্বপ্ন দিয়ে তাড়াতে চাই দু:স্বপ্ন। বিশ্ব টেলিভিশন দিবসের মর্যাদাপূর্ণ দিনে আমরা বিশ্বাস করতে চাই, টেলিভিশনই হবে গণমানুষের যথার্থ কণ্ঠস্বর।
লেখক: একুশে টেলিভিশনের প্রধান বার্তা সম্পাদক