প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন অবসরে যাচ্ছেন আগামী ৩০ ডিসেম্বর। তিনি অবসরে গেলে কে হচ্ছেন পরবর্তী প্রধান বিচারপতি-এ নিয়ে কয়েকদিন ধরেই জোর আলোচনা চলছে বিচারাঙ্গনে। এতে আপিল বিভাগের চার বিচারপতির নাম এলেও নিয়োগ পাবেন একজন। চারজনের তালিকাটি ছোট করলে ঘুরে ফিরে আসছে প্রথমদিকের দুজনের নাম। তবে আলোচনায় থাকা দুই বিচারপতির নাম থাকলে মুকুটটি পরতে যাচ্ছেন কুষ্টিয়ার খোকসার হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
আপিল বিভাগের বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে পরবর্তী প্রধান বিচারপতি করা হয়েছে বলে একটি বিশ্বস্ত সূত্র কুষ্টিয়ার সময়কে নিশ্চিত করেছে। সূত্রটি বলছে, নিয়োগ প্রক্রিয়া ইতোমধ্যেই সম্পন্ন। বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে বাংলাদেশের ২৩তম বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের প্রজ্ঞাপন কাল প্রকাশ করা হবে। প্রজ্ঞাপন প্রকাশের পরই রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তাকে শপথ পাঠ করাবেন।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা যায়, আপিল বিভাগে চার বিচারপতির তিনজনেরই অবসরের মেয়াদ ২০২৩ সালের মধ্যে। সংবিধান অনুযায়ী, ৬৭ বছর বয়স পর্যন্ত বিচারপতি পদে থাকা যায়। সে হিসেবে বিচারপতি ইমান আলী অবসরে যাবেন ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি। তিনি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেলে তার মেয়াদকাল হবে এক বছর। আর বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী নিয়োগ পেলে তার প্রধান বিচারপতির মেয়াদকাল হবে দেড় বছরের বেশি। কারণ তার মেয়াদকাল ২০২৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার এ বিষয়টিকেই দেয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে ওই সূত্রটি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগে আপিল বিভাগের বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলীর নাম শোনা গেলেও দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীই চূড়ান্ত। তারা বলছেন, সার্বিক বিশ্লেষণে দেশের পরবর্তী প্রধান বিচারপতি করা হচ্ছে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে।
আইন ও বিচার-সংশ্নিষ্ট শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে, প্রধান বিচারপতি নিয়োগে এবারও নানা সমীকরণ ছিল। জ্যেষ্ঠতা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা না থাকায় এই নিয়োগে তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিচার বিভাগের স্থিতিশীলতা, রাজনৈতিক মেরূকরণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহা ও বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিয়ার পদত্যাগের ঘটনা বিবেচনায় প্রধান্য পেয়েছে।
এ ছাড়াও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী একইসঙ্গে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে আসছেন। রাষ্ট্রপতি প্রথম দফায় ২০১৫ সালের ৩০ এপ্রিল তাকে ওই পদে নিয়োগ দেন। পরে তার মেয়াদ বাড়ানো হয়। জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন অধস্তন আদালতে বিচারক নিয়োগ-সংক্রান্ত পরীক্ষাসহ যাবতীয় কাজ এবং এর সঙ্গে সংশ্নিষ্ট বিষয়ে কোনো প্রশ্নের উদ্ভব হলে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিয়ে থাকে। এই হিসেবে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী প্রধান বিচারপতি পদে পছন্দের তালিকায় সবার শীর্ষে।
তবে কে হবেন ২৩তম প্রধান বিচারপতি তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে রাত পর্যন্ত। নিয়োগের ক্ষেত্রে সংবিধানে জ্যেষ্ঠতা অনুসরণের বিষয়ে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত করার ক্ষমতা কেবল রাষ্ট্রপতির। এ বিষয়ে সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করিবেন।’ এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলা হয়নি।
দীর্ঘদিনের রীতি অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে প্রধান বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ দিতে তার বিষয়ে সম্মতি দিয়ে প্রথমে আইন মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে। এরপর এ সংক্রান্ত ফাইল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হয়ে এসেছে বঙ্গভবনে। সেখানে রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরের পর প্রধান বিচারপতি নিয়োগের গেজেট জারি করবে আইন মন্ত্রণালয়। গেজেট জারির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
তবে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, সংবিধান অনুসারেই রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেবেন। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন আগামী ৩০ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) অবসরে যাবেন। পরদিন ৩১ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি নিয়োগ সম্পন্ন হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
যদিও এর আগে প্রধান বিচারপতির অবসরের আগেই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার রেওয়াজ আছে।
হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী দেশের শীর্ষ আদালতে ৯০ এর দশকের এক অনন্য ডাকসাইটে আইনজীবী। তিনি আইনজীবিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন যার হাতে ছিল মামলার দীর্ঘ তালিকা। তিনি ২০ বছর ক্যারিয়ার আইন অনুশীলন করেন। এই সময়ে তিনি অত্যন্ত নিরপেক্ষতার সাথে নানা ধরনের মামলা পরিচালনা করেন। আইনের পক্ষে সত্য ও ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করতে ভূমিকা পালন করেন।
হাসান ফয়েজের আইনজীবী জীবনের অধ্যায়টি শেষ হয় ২০০১ সালে যখন তিনি আওয়ামী লীগ সরকার তাকে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক হিসাবে নিয়োগ দেন। ২০১৫ সালের ৩০ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি তাকে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসাবে নিয়োগ দেন। বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান আইন উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৯ সালে হাইকোর্ট বিভাগের ও ২০১৩ সালে আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন তিনি।
বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ১৯৫৬ সালে কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার রমানাথপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। তার শৈশব কেটেছে গড়াই নদীর তীর ঘেঁষা প্রত্যন্ত গ্রামে।
তিনি গ্রামের আজইল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। প্রাথমিক সমাপনের পরে তিনি খোকসা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৭২ সালে তিনি খোকসা-জানিপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন।
এর পর তিনি সাতক্ষীরার আচার্য্য প্রফুল্ল কলেজে ভর্তি হন। ১৯৭৪ সালে তিনি এই কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। তিনি সাতক্ষীরা কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৭৬ সালে স্নাতক পাস করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি ১৯৭৮ সালে এমএ করেন।
তারপরে তিনি ধানমন্ডি ল কলেজে এলএলবিতে ভর্তি হন এবং ১৯৭৯ সালে আইন ডিগ্রি গ্রহণ করেন। সফলভাবে পড়াশোনা শেষ করার পরে তিনি পেশাদার আইনজীবী হিসাবে তার ক্যারিয়ার গড়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৮১ সালে তিনি ঢাকা বারে যোগদান করেন এবং ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টে আইনজীবী তালিকাভুক্ত হন।