হাট-বাজারে পেট্রোল বোমা, তাও আবার আকারও বড়! নিশ্চয়ই আতঙ্কিত হওয়ার মতো বাক্য! ঘটনাও ঠিক এমনই শঙ্কার। কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার কয়েকটি স্থানে ব্যারেল এবং প্লাস্টিকের কন্টেইনারে নিয়মিত বিক্রির জন্য মজুদ করা হচ্ছে হাজার-হাজার লিটার পেট্রোল-অক্টেন ও ডিজেলের মতো জ্বালানী তেল। এই ব্যবসা বিস্ফোরকের ব্যবসার মতো ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় দেশে এর নিয়ন্ত্রণ বিস্ফোরক পরিদপ্তরের কাছে। তবে, নানা অযুহাতে ভয়াবহ এই ঝুঁকি ও বেআইনী কার্যক্রমকে তোয়াক্কা করছেন না ব্যবসায়ীরা।
গত ১২ আগস্ট রাতে দৌলতপুরের পাশ্ববর্তী উপজেলা ভেড়ামারার দফাদার ফিলিং স্টেশনের খোদ তেল মজুদের ভূ-গর্ভস্থ ট্যাংকিতে বিস্ফোরণে নিহত হয় ৪ জন, তা-ও এদের তিনজনই ক্রেতা বা ক্রেতার সঙ্গী, এতে আরও কয়েকজন আহত হয়েছেন, এ ঘটনার পর জ্বালানী তেল মজুদের বিষয়টি নিয়ে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে এই অঞ্চলে। বিভিন্ন এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ বড় মজুদের তথ্য আসতে থাকে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে। বিভিন্ন এলাকায় ভয়াবহ এই কর্মকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসী।
এলাকা ঘুরে দেখা যায়, দৌলতপুর আখ সেন্টার মোড় এলাকার ব্যবসায়ী মজনু রহমান, হোসেনাবাদ বাজার এলাকার ব্যবসায়ী আতাউর রহমান একই এলাকার ব্যবসায়ী রিপেল, মথুরাপুর গরুর হাট সংলগ্ন বড় বাজার এলাকার ব্যবসায়ী হাচিবুর রহমান হাচিব মজুদ করছেন হাজার-হাজার লিটার ডিজেল-পেট্রোল-অক্টেন।
এসব মজুদদাররা দেখাচ্ছেন কাগুজে অনুমতিপত্র, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কেউই মানছেন না যথাযথ নিয়ম, তাদের মজুদ রাখা জ্বলানীকে বোমার সাথে বসবাস বলে মন্তব্য করছেন পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এলাকাবাসী। নির্দেশনায় সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি দেখিয়ে সংরক্ষণ ও কেনা-বেচা করার কথা বলা হলেও এসবের কোন ছাপই নেই ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়। ১০,২০ থেকে ৪০ হাজার লিটার পেট্রোল মজুদ করছেন অনিয়মের ঘরে। কারো ঘরে পেট্রোলের কন্টেইনার ঘেঁষে ইলেকট্রিক লাইন। কেউ আবার, একটি মজুদঘরের অনুমতি নিয়ে চালাচ্ছেন একাধিক। বিশেষ ধরনের অবকাঠামোর ঘর সহ কন্টেইনার রাখার দুরত্বের কথা গুরুত্ব দিয়ে বলা হলেও কেউই মানছেন না এসব নিয়ম। তামার তারের ব্যবহার, ভেন্টিলেশন ব্যবস্থার মতো কয়েকপদের নির্দেশ নিয়ে ভাবাই দায়। ঝুঁকি জেনেও মজুদদাররা রাখেননি নির্দেশনা অনুসারে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা।
এমন পরিস্থিতিতে হোসেনাবাদের রিপেল জানান, পেট্রোল, ডিজেল, সয়াবিন, পাম-ওয়েল পাশাপাশি রেখে বিক্রয় করছেন তিনি। কাগজের দোহায় দিয়ে বলেন, এভাবেই চলছে কোন সমস্যা হচ্ছে না। রীতিমতো মটোর ইঞ্জিন ব্যবহার করে জ্বলানী সরবারাহ করেন তিনি হোসেনাবাদ বাজারের একটি ছোট্ট সাইজের দোকান থেকে। পুরো ঘরেই এলোমেলো ইলেকিট্রক লাইন। আছে ফ্যান, গান শোনার সাউন্ডবক্স, টেলিভিশন। এছাড়াও একই ঘরে অন্তত তিনটি অরক্ষিত ইলেক্ট্রিক প্লাগইন বোর্ড।
দৌলতপুরে সবচে’ বেশি মজুদ দেখা যায় মথুরাপুরের হাচিবুর রহমানের, একাধিক গুদামঘরে জ্বালানী তেল মজুদ করছেন তিনি। প্লাস্টিকের কন্টেইনার ও ব্যারেলে করে পেট্রোল ভরে টিনের ছাউনির ঘরে একটার ওপর আরেকটা গাদা মেরেছেন মথুরাপুরের এই ব্যবসায়ী। কী ধরণের অনুমতি নিয়ে এধরণের মজুদ করেছেন জানতে চাইলে তা জানাতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। এসময় বলেন, ডিসি,ইউএনও,এসিল্যান্ড, বিস্ফোরক পরিদর্শক সবাই পরিদর্শণ করে গেছে, তারা আমার ব্যবসা দেখে সন্তুষ্ট। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এধরণের কোন পরিদর্শণ বা সন্তুষ্টি প্রকাশের ঘটনা ঘটেনি। এসময়, মূল তেলের ব্যবসার পাশের আরেকটি কক্ষে হাতে এক বান্ডেল টাকা নিয়ে ইশারায় ও মৌখিক ভাবে প্রতিবেদককে কক্ষের ভিতরে যেতে ডাকতে থাকেন তিনি।
দৌলতপুরে ঝুঁকিপূর্ণ জ্বালানী মজুদ প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল জব্বার বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের অনুরোধ যথাযথ কর্তৃপক্ষের দেয়া নিয়মানুযায়ী জ্বালানী মজুদ করবেন। নিরাপদ তেল মজুদের স্থান নির্ধারণ, পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র স্থাপনসহ সকল শর্তাবলী যথাযথ অনুসরণ পূর্বক জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ব্যবসা পরিচালনা ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সবাইকে অনুরোধ করছি।
খুলনা বিভাগীয় বিস্ফোরক পরিদর্শক ডক্টর মো: আসাদুল ইসলামের সাথে টেলিফোনে কথা বলে জানা গেছে, এধরনের মজুদদাররা সাধারণত লাইসেন্স গ্রহণের সময় এক রকমের প্রেক্ষাপট দেখান, পরে ব্যবসা পরিচালনা করেন নিজেদের খেয়ালখুশি মতো, যা ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ। ব্যবসায়ীরা প্রতারণামূলক আচরণ করে নিজেসহ অন্যকে জীবনের ঝুঁকিতে রাখছেন। দ্বিতীয় শ্রেণীর মজুদদাররা পেট্রোল মজুদ করতে পারবেন না বলেও জানান তিনি।
এসময় ড. মো: আসাদুলের কাছে সুরাহা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, খুলনা থেকে সার্বক্ষণিক মনিটরিং সম্ভব না এমনকি জনবল সংকটে নিয়মিত মনিটরিংও কঠিন হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে স্থানীয় ভাবে উপজেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।
পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় সাধারণত এককালীন বিনিয়োগে ফাঁকি এবং ব্যবসায় মাত্রাতিরিক্ত লাভের প্রত্যাশায় উপজেলাটিতে ভয়াবহ ঝঁকিপূর্ণ এই প্রেক্ষাপট তৈরি করেছেন হাতে গোনা কয়েকজন ব্যবসায়ী। স্থানীয় প্রশাসনের অংশগ্রহণে অনতিবিলম্বে পরিস্থিতির সমাধান প্রত্যাশী সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসী।