বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ০৩:৫৪ পূর্বাহ্ন

পদ্মার বুকে শতবর্ষের স্মৃতি হার্ডিঞ্জ ব্রিজ

কুষ্টিয়ার সময় অনলাইন ডেস্ক / ২০৩ বার নিউজটি পড়া হয়েছে
আপডেট টাইম: সোমবার, ১২ জুন, ২০২৩, ২:১৫ অপরাহ্ন

এক দিকে অপরূপ সৌন্দর্য আর অপর দিকে প্রজন্মের পর প্রজন্মের সাক্ষী হয়ে পদ্মার বুকে আজো দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহ্যবাহী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। বহু বছর আগে বাংলাদেশের পদ্মা নদীর বুকে তৈরি করা হয়েছিল এই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। তখন পদ্মার জলরাশি আর খরস্রোতা উত্তাল ঢেউ ছিল, ছিল ভরা যৌবন। পদ্মার সেই যৌবন হয়তো শেষ হতে চলেছে, কিন্তু চিরযৌবনা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পদ্মার বুকে এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সাথে দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম সেতুবন্ধন তৈরি করেছে ঐতিহাসিক এই ব্রিজটি। পাবনা আর কুষ্টিয়া জেলাকে সংযুক্তকারী রেলসেতু হলো হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, যা বাংলাদেশের দীর্ঘতম রেলসেতু। এই সেতুটি পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশি হতে কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলা পর্যন্ত সংযুক্ত করেছে। এই ব্রিজ স্থাপনের এক বিশাল ইতিহাস রয়েছে।

১৮৮৯ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার কলকাতার সাথে আসাম, ত্রিপুরাসহ উত্তরাঞ্চলের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগব্যবস্থা স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এই ব্রিজ তৈরির প্রস্তাব করেছিলেন। সেই সময় প্রস্তাবটি কার্যকর হয়নি। তবে এর প্রায় দুই দশক পর ১৯০৮ সালে ব্রিজ নির্মাণের মঞ্জুরি পাওয়ার পর ব্রিটিশ প্রকৌশলী স্যার রবার্ট উইলিয়াম গেইলস ও স্যার ফ্রান্সিস স্প্রিংয়ের ওপর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণের দায়িত্ব পান। প্রধান প্রকৌশলী আলেকজান্ডার মেয়াডোস রেন্ডেল ব্রিজের নকশা প্রণয়ন করেন। ১৯০৯ সাল ব্রিজটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ১৯১৫ সালে শেষ হয়। ব্রিজ নির্মাণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ছিল রেইথ ওয়ালটি অ্যান্ড ক্রিক। এ সময় প্রমত্তা পদ্মার রূপ ছিল ভয়াল। ব্রিজে রয়েছে ১৫টি মূল স্প্যান। একেকটি স্প্যানের ওজন এক হাজার ২৫০ টন। ১৫টি স্প্যান ছাড়াও দুই পাশে রয়েছে ৩টি করে মোট ৬টি অতিরিক্ত ল্যান্ড স্প্যান।

এই ব্রিজ নির্মাণে ২৪ হাজার ৪০০ শ্রমিক-কর্মচারী টানা পাঁচ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন। তৎকালীন হিসাব অনুযায়ী ব্রিজ নির্মাণে মোট ব্যয় হয়েছিল ৩ কোটি ৫১ লাখ ৩২ হাজার ১৬৪ ভারতীয় রুপি। ব্রিজ নির্মাণের শত বছর পরেও পৃথিবীর প্রকৌশলীদের কাছে আজও বিস্ময়, ব্রিজ নির্মাণের কাজ বা রিভার ট্রেরিং ওয়ার্ক। ১৯১২ সালে ব্রিজের গাইড ব্যাংক নির্মাণের কাজ শুরু হয়। প্রায় ৪-৫ মাইল উজান থেকে ব্রিজের গাইড ব্যাংক বেঁধে আনা হয়। লোহা ও সিমেন্টের কংক্রিটের সাহায্যে নির্মিত হয় বিশাল আকৃতির পায়াগুলো। সেই সময়ের হিসাব অনুযায়ী মূল স্প্যানের জন্য ব্যয় হয় এক কোটি ৮০ লাখ ৫৪ হাজার ৭৯৬ রুপি। স্থাপনের জন্য পাঁচ লাখ ১০ হাজার ৮৪৯ রুপি, নদী শাসনের জন্য ৯৪ লাখ ৮ হাজার ৩৪৬ রুপি এবং দুই পাশের রেললাইনের জন্য ৭১ লাখ ৫৫ হাজার ১৭৩ রুপি ব্যয় হয়। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের বিশেষত্ব হলো ভিত্তির গভীরতা।

হার্ডিঞ্জ ব্রিজের দৈর্ঘ্য এক হাজার ৭৯৮ দশমিক ৩২ মিটার বা পাঁচ হাজার ৮৯৪ ফুট বা এক দশমিক ৮ কিলোমিটার। এর উপরে রয়েছে দুইটি ব্রডগেজ রেললাইন। ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক এই ব্রিজটি ১৯১৫ সালের ৪ মার্চে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। তার নাম অনুসারে ব্রিজটির নামকরণ করা হয় ‘হার্ডিঞ্জ ব্রিজ’।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী এই ব্রিজের ওপর দিয়ে ট্যাংক, যুদ্ধসরঞ্জামসহ সৈন্য পারাপার করত। ফলে মিত্রবাহিনীর যুদ্ধবিমান থেকে এই ব্রিজের ওপর বোমা ফেলা হয়েছিল। এতে ব্রিজের ১২ নম্বর স্প্যান ভেঙে গিয়েছিল এবং ৯ ও ১৫ নম্বর স্প্যান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যা পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ সরকারের সাহায্যে মেরামত করা হয়েছিল। এরপর ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর থেকে পুনরায় ব্রিজটির ওপর দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হয়।

২০১৫ সালে ঐতিহ্যবাহী এই হার্ডিঞ্জ ব্রিজের শতবর্ষ পূরণ হয়।
শৈল্পিক কারুকার্যে খচিত বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক লাল রঙা এই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ১০০ বছর পেরিয়ে এখনো পর্যন্ত দর্শনার্থীদের মন আকৃষ্ট ও মুগ্ধ করে চলেছে। এ ছাড়া এই ব্রিজটির ঠিক পাশ দিয়েই ২০০৪ সালে তৈরি করা হয়েছে একটি সড়কসেতু, যা কুষ্টিয়া জেলার বিখ্যাত সাধক ফকির লালন শাহের নামানুসারে লালন শাহ সেতু নামে পরিচিত।

প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা এসে ভিড় জমায় এখানে, কেউবা আসে নৌকা ভ্রমণের মাধ্যমে এই অপরূপ সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে। এ ছাড়া প্রতি বছর বিদেশী পর্যটকদেরও আনাগোনা দেখা যায় এই স্থানে। নির্মাণের ১০০ বছর পেরিয়ে গেলেও উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী এই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ স্বচক্ষে দেখার কৌতূহল যেন আজো মানুষের মনে রয়ে গেছে।


আপনার মতামত লিখুন :

Comments are closed.

এ জাতীয় আরো খবর...
এক ক্লিকে বিভাগের খবর