ঘড়ির কাঁটায় বেলা ১১ টা বেজে ৫২ মিনিট। মেঝে পাকা ঘরের ভেতর শুয়ে আছেন বৃদ্ধ হাসিনা বেগম (৭০)। চোখে ছলছল জল। ঘরের বারান্দায় ছেলের ছবির পাশে আনমোনা বসে আছেন তাঁর স্বামী হারুন অর রশিদ (৮৪)। তাঁদের শরীরে দানা বেধেছে হাঁপানী, শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগ।
তাঁদের বাস কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার জয়ন্তীহাজরা ইউনিয়নের ফুলবাড়ী গ্রামে। শনিবার (১৯ আগষ্ট) সরেজমিন তাঁদের বাড়িতে গিয়ে এদৃশ্য দেখা যায়।
এই দম্পতির দশ সন্তানের মধ্যে মেঝো ছিলেন মাহবুবুর রশিদ। বড় ছেলে জন্মের দুই বছরের মধ্যে মারা গিয়েছিলেন। সেজন্য রশিদই ছিলেন পরিবারের বড় সন্তান। যিনি ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় গ্রেনেড হামলায় নিহত হয়েছিলেন।
ওই বৃদ্ধ বাবা মার চোখে আজও অমলিন ছেলের স্মৃতি। তা বুকে ধারণ ও লালন করে চলেছেন। ছেলের নিহত হবার খবর শোনার পর মায়ের বুক কেপে উঠেছিল। নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন বাবা। এই বাবার নির্বাকতা এবং মায়া ও কেপে ওঠা বুক থামানোর জন্য ছেলে হত্যাকারীদের ফাসির রায় কার্যকরের অপেক্ষার প্রহর গুনছেন তাঁরা। তাঁদের বড় আশা মরার আগে হত্যাকারীদের শাস্তি যেন দেখে যেতে পারেন।
১৯৬৮ সালে জন্মগ্রহণ করা মাহবুব ২০০১ সালে সেনাবাহিনী থেকে তিনি অবসর নেন। কিছুদিন পরই শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে যোগদান করেন। ২১ আগস্ট ঢাকা বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এ আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি।
জানতে চাইলে কথা প্রসঙ্গে বিলাপ করতে করতে বাবা হারুন অর রশিদ বলেন, ‘ এতোদিন হয়ে গেল খুনিদের বিচার ( শাস্তি) হলোনা। শরীরে এ্যাজমা, হাঁপানী, শ্বাসকষ্ট। মাসে ১৫ -১৬ হাজার টাকার ঔষুধ লাগে। মরার আগে খুনিদের শাস্তি দেখে যেতে চাই। না হয় আমার আল্লাহ’ য়াই খুনিদের বিচার করবে। এখন আল্লাহর হাতেই ছাড়ে দিছি বিচার। ‘
বড় ছেলে মাহবুবুর রহমানই ছিলেন সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম। সেই ছেলেকে হারিয়ে বাবা হারুন অর রশিদের দু:খ বার মাস। তবে শেখ হাসিনাকে রক্ষা করতে গিয়ে ছেলের জীবন চলে যাওয়াকে তিনি শহিদ হিসাবে মনে করছেন। তাই ছেলের সমাধির স্থল সংস্করসহ সেখানে বিদ্যুতের আলোর ব্যবস্থা করার দাবি জানান হারুন অর রশিদ।
কথা প্রসঙ্গে মৃদু স্বরে শুয়ে শুয়ে হাসিনা বেগম জানালেন, শারীরিক অবস্থা তেমন ভালো না। বুকের মধ্যে ধরফর করে ওঠে। বয়সের ভারে এখন আর বুক ভরে শ্বাস নিতে পারিনা। আগষ্ট মাস আসলেই কষ্ট ও জ্বালা বেড়ে যায়।
জানা গেছে, গ্রামের বাড়িতে শুধুমাত্র বাবা-মা বাস করেন। প্রতি ২১ আগষ্টের সপ্তাহখানেক আগে থেকে এই বাড়িতে সাংবাদিকেরা হাজির হয়। কিন্তু তাঁর ছেলেকে হাজির করতে পারে না কেউ। তবু বাবা মা আশায় বুক বেধে আছেন ছেলের হত্যাকারীদের ফাসির রায় কার্যকর যেন দেখে যেতে পারেন। সেই খবর শোনার অপেক্ষায় থাকেন তাঁরা।
প্রধানমন্ত্রী তাঁদের নিয়মিত খোঁজখবর রাখলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কোনো খবর রাখেননা। প্রতি বছরের মতো এবারও ছেলের মৃত্যুবার্ষিকীতে বাড়িতে মিলাদ মাহফিলের ব্যবস্থা করেছেন। প্রতিমাসে কল্যান ফান্ড থেকে যে টাকা দেওয়া হয় তা এবং এক মেয়ের পাঠানো টাকা দিয়ে দুই জনের সংসার কোন রকম চলে যায়। এছাড়া বাড়িতে গাভির দুধ বিক্রি করে ছেলের মৃত্যুবার্ষিকী পালনের জন্য কিছু টাকা জমিয়ে রাখেন।