শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৪৪ অপরাহ্ন

খোকসার পতিতালয়-পতিতাবৃত্তির ইতিবৃত্ত!

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক / ১২১৪ বার নিউজটি পড়া হয়েছে
আপডেট টাইম: রবিবার, ৯ এপ্রিল, ২০২৩, ৪:০৫ পূর্বাহ্ন

কুষ্টিয়ার খোকসা একটি প্রাচীন জনপদ। যদ্দুর শোনা যায় ‘খোকা শাহ’ নামের এক সাধকের নাম থেকে খোকসা নামের উৎপত্তি হয়েছে। আবার কারো কারো মতে ‘খোকসা’ নামক গাছ থেকে খোকসা শব্দের উৎপত্তি। তবে ‘খোকসা’ নামক গাছ অনেক আগেই বিলুপ্ত হলেও বর্তমান রংপুর অঞ্চলের কিছু কিছু এলাকায় খোকসা নামক গাছ এখনও আছে।

জীবনধারণের যতগুলি উপায় প্রাচীনতম, তার মধ্যে বেশ্যাবৃত্তি অন্যতম। ব্রিটিশ আমলের শুরুতেই খোকসার গড়াই নদীর তীরে অবস্থিত জানিপুর পুরাতন বাজারের ঘেঁষেই গড়ে উঠে একটি পতিতালয়। সে সময় এখানে একটি ছোট-খাটো বন্দর ছিল। গড়াই নদীর বুক চিড়ে স্টিমার এসে ভিড়তো। শালকাঠের আড়ৎ ছিল। বাদাবন থেকে ধান আসত। ধানের হাট বসতো নিয়মিত। গড়াই নদীর কড়াল গ্রাসে এসব বিলীন হয়ে গেলে ১৯৪০ সালের গোড়ার দিকে পতিতালয়টি স্থানান্তরিত হয় কালীবাড়িতে।

কুষ্টিয়ার প্রখ্যাত সাহিত্যিক ড. আবুল আহসান চৌধুরী তাঁর ‘অবিদ্যার অন্তঃপুরে, নিষিদ্ধ পল্লীর অন্তরঙ্গ কথকতা’- বইটিতে লিখেছেন ‘বেশ্যাবাজি ছিল বাবু সমাজের সাধারণ ঘটনা। নারী আন্দোলনের ভারত পথিক রাজা রামমোহন রায়েরও রক্ষিতা ছিল। এমনকি ওই রক্ষিতার গর্ভে তার একটি পুত্রও জন্মেছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর পতিতা সুকুমারী দত্তের প্রেমে মজেছিলেন। সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেন নিয়মিত বেশ্যাপাড়ায় যেতেন তা তিনি নিজেই তার ডায়েরিতে লিখে গেছেন। মরমি কবি হাসন রাজা, কথা শিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিয়মিত পতিতালয়ে যেতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও পতিতালয়ে যেতেন। নিষিদ্ধপল্লীতে গমনের ফলে রবীন্দ্রনাথের সিফিলিস আক্রান্ত হওয়ার খবর তার জীবদ্দশাতেই ‘বসুমতী’ পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল।’

সব যুগে, সব সভ্যতায়, বেশ্যাদের নিন্দা করা হয়েছে। আবার তাদের প্রতি মুগ্ধতায়ও ছড়িয়ে রয়েছে সমাজের সর্বস্তরে। খোকসার মানুষ হিসেবে সেসময় যৌনপেশায় নিয়োজিত মানুষগুলো, তাদের সুখ-দুঃখ, কাজের পরিবেশ জানতে ও জানাতেই আমার ছোট্র এই নিবন্ধ। তবে বেশ্যাদের জীবনসত্য থেকে যায় আলো-আঁধারিতে। বিভিন্ন সূত্র থেকে আহরিত তথ্য রয়েছে এ নিবন্ধে। শিরোনাম বিষয়ে এমন পূর্ণাঙ্গ আলোচনা এই প্রথম বলে দাবিও রাখি।

পতিতাবৃত্তির অপর নামসমূহ গণিকাবৃত্তি, যৌনবৃত্তি, বেশ্যাবৃত্তি ইত্যাদি। ইতিহাসের আদিকাল থেকে এদের বিভিন্ন নামেও ডাকা হয়। যেমন- দেহপসারিণী, বেশ্যা, রক্ষিতা, খানকি, উপপত্নী, জারিণী, পুংশ্চলী, অতীত্বরী, বিজজব্রা, অসোগু, গণিকা, কুলটা, বারণবণিতা, কুম্ভদাসী, নটি, রূপজীবা ইত্যাদি। এ পেশায় নিয়োজিতরা নিজদেহ নিয়ে ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করে। অর্থাৎ নিজদেহ স্বেচ্ছায় অপরকে ভোগ করার সুযোগদানের বিনিময়ে অবৈধপন্থায় অর্থোপার্জন।

খোকসার কালীমন্দিরে ঢুকতেই শচীন মাস্টারের বর্তমান বাড়িটিতেই নতুন করে গড়ে উঠে পতিতালয়টি। মাত্র ১৫-২০ কাঠা জমির উপর। সেসময় ঘর ছিল মাত্র ১০-১৫টি। পতিতাদের সংখ্যা ছিল মাত্র ২০-২৫ জন। কুমুদিনী নামক একজন যৌনকর্মী বাড়িওয়ালা হিসেবে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। ১৯৬৯ সালের দিকে কিছু ধর্মপ্রাণ মানুষ ও জামাতপন্থীদের কু-দৃষ্টি পড়ে এ বেশ্যালয়ের উপর। অবশেষে উচ্ছেদ করতে সক্ষম হয়। খোকসার বেশ কিছু মানুষ ওই সব পতিতাদের স্ত্রী করে ঘরে তুলে নেন। সামাজিক নিরাপত্তার কথা ভেবে পতিতালয় উচ্ছেদকারী জামাত নেতা ও পতিতাদের স্বামীর নাম প্রকাশ করা হলো না।

অবশেষে বাড়িওয়ালা কুমুদিনী দেবী এসে আশ্রয় নেন খোকসা থানার পাশে বর্তমান যে স্থানটি ফিটুর মেস নামে পরিচিত। পরবর্তীতে ওই জমিটি কিনে নেন জনৈক আমজাদ হোসেন নামে এক ব্যক্তি। এভাবে খোকসার পতিতাবৃত্তির ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটে।

ডা. লুৎফর রহমান তার ‘মহাজীবন’ গ্রন্থে লিখেছেন ‘এই সমাজে যদি তাদের (গণিকাদের) প্রয়োজন নাই থাকত তাহলে তারা অনেক আগেই হারিয়ে যেত।’ প্রবীর কুমার চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘কালিকা পুরোনোক্ত দুর্গাপূজা পদ্ধতি’ বইয়ের ৭২, ৮৬, ১০৮, ১২৭ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত, হিন্দুরা মনে করে, বেশ্যারা এ সমাজকে নির্মল রাখে। আর সেই কারণেই দুর্গাপূজার সময় বেশ্যার দরজার মাটি অপরিহার্য। দুর্গাপূজার সময় দশ ধরনের মাটি প্রয়োজন হয়। তার মধ্যে বেশ্যার দরজার মাটি অপরিহার্য।

অবশেষে যে কথা দিয়ে শেষ করতে চাই। বেশ্যাদের অমর্যাদা দূর করতে কি বেশ্যাবৃত্তি পেশাটাকেই মুছে দেওয়া দরকার ছিল সে সময় জামায়াত নেতাদের, না নিষ্পেষণ দূর করে, তাদের কাজকে অন্য পাঁচটি পেশার মতো মর্যাদা দেওয়াটা জরুরি ছিল। পাঠকই এর জবাব দেবেন…

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট, মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী


আপনার মতামত লিখুন :

Comments are closed.

এ জাতীয় আরো খবর...
এক ক্লিকে বিভাগের খবর