বেসরকারি কলেজের শিক্ষক সাইফুল ইসলাম (ছদ্মনাম) যাবেন শশুর পক্ষের আত্মীয়ের বিয়ের বরযাত্রী। সেই হিসাবেই চৈত্রের গরম খুব একটা তোয়াক্কা না করে বউ-শিশু নিয়ে সেজেগুজে তৈরি হয়েছেন আটঘাট বেঁধেই। সম্মান করে ভাড়া করা গাড়িতে শিক্ষকের বাড়িতেই নিতে পাঠিয়েছেন তাদের। যথারীতি সারাদিনের জন্য গাড়িতে উঠতে সময় লাগার কথা মিনিট দশেক এরমধ্যেই চালকের হাঁকডাক হর্নের শেষ নেই। গাড়িতে বসে মিনিট পাঁচেক যাওয়ার পর।
পদার্থবিজ্ঞানের ওই শিক্ষক আবিষ্কার করলেন গাড়ির একটি কাঁচও আসল না এমনকি সেটি গাড়িতে ব্যবহারের উপযোগীও না। এ কারণে বাইরের গরম আবহাওয়া ভেতরে বেশি অনুভূত হয়। গাড়ির গড়নেও হালকা সমস্যা, খোলা জানালা দিয়ে পর্যাপ্ত বাতাস ভিতরে ঢুকছে না। এসি বিকল। এই অবস্থায় প্রথমে বরের বাড়ি তারপর বরযাত্রী হয়ে কনের বাড়ির সফরে বাগড়া দিলো ৩০ মিনিট পথের বরের বাড়ির দুরত্বেই।
স্ত্রী-সন্তান দুজনেই ভ্যাপসা গরম আর গাড়ির নোংরা গন্ধে অসুস্থপ্রায়। বরযাত্রীদের পূর্ব নির্ধারিত গাড়ি অনুসারে নিজের জন্য বরাদ্দ থাকা গাড়ি ছেড়ে আরেক আত্মীয়ের ব্যক্তিগত গাড়িতে ঠাসাঠাসি করে রওনা হলেন বরযাত্রী।
এ দিকে ঘোর বর্ষায় অসুস্থ বাবাকে হাসপাতালে নেয়ার প্রয়োজনে পূর্বের জানাশোনা অনুযায়ী তুলনামূলক কমভাড়ায় মাইক্রোবাস নিয়েছে নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত তরুণ সুজন (ছদ্মনাম)। তার জানাশোনায় অন্যান্য গাড়ির মতো এটিও ভাড়ায় চলা মাইক্রোবাস। খানেকপথ গিয়ে গাড়ির ঝনঝনানি বেড়ে গেলো! গাড়িতে রোগী থাকায় ড্রাইভার চেষ্টাও করছিলো দ্রুত চালিয়ে যেতে। একপর্যায়ে বন্ধ হলো গাড়ি।
প্রায় ২৫ মিনিট হতে চললেও সম্ভব হয়নি ফের চালানো। লক্কর-ঝক্কর (তার মতে) গাড়ি রেখে বন্ধুর মোটরসাইকেলে বসিয়েই সেদিন বাবাকে নিয়ে শেষমেশ হাসপাতালে যাওয়া হয় সুজনের।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তভোগী এক গৃহবধুও দুঃখ করছিলেন পরিবারসহ ভাড়ায় চালিত গাড়িতে চড়ে বিপাকে পড়া প্রসঙ্গে। শুভযাত্রায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি ছেড়ে এক পর্যায়ে মাঝপথে নেমে পড়তে হয়েছিলো তাদের। এখানেই শেষ না! মাঝপথে গাড়ি ছেড়ে দেয়ায় হুমকিও দিয়েছিলেন সর্বোচ্চ লাখতিনেক বাজার দরের ওই গাড়ির মালিক।
দৌলতপুরের স্কুল ছাত্রী উষা, গৃহবধু জহুরা, মিরপুরের কিশোর সিয়াম কিংবা শ্যালোর গাড়িচালক কিশোর মিলনের মতো কথিত স্টেয়ারিংয়ে প্রাণ হারানো বা বিকলাঙ্গের সংখ্যা আশঙ্কাজনক মনে করছেন স্থানীয়রা।
তাছাড়া, ড্রাম ট্রাকের (প্রচলিত নামের ভারী মালবাহী গাড়ি) দৌরাত্ম আর ভয়াবহতায় এমনিতেই কাঁপে জেলার সড়কগুলো।
এমন অভিযোগের সংখ্যাও কম নয়- গণপরিবহনে নির্ধারিত ভাড়ার তুলনায় অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, নিম্নমানের সেবা প্রদান আর অশোভন আচরণ!
ফিটনেসহীন আর অবৈধ গাড়িতে সয়লাব কুষ্টিয়ার সড়ক-মহাসড়ক। যে যার মতো ভাড়া আদায় করছেন ব্যবসায়ীরা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেবা নগণ্য। এলাকাবাসীর এমন গণঅভিযোগ দীর্ঘ সময়ের হলেও বেশ চেষ্টা থাকা সত্বেও সড়ক থেকে অবৈধ ও ঝুকিপূর্ণ যানবাহন সরাতে এখনও ব্যর্থ সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। উল্টো নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে বিভিন্ন থানা ও হাইওয়ে পুলিশের বিরুদ্ধেও।
জেলায় অন্তত অর্ধশত অচল প্রকৃতির মাইক্রোবাস। বেশ কয়েকটি ফিটনেস ও সেবা দুর্বল বাস। তারউপর অন্তত ৫ হাজার শ্যালো ইঞ্জিন চালিত ভয়ংকর অবৈধ গাড়ি চলে কমবেশি সব সড়কেই। যা দিয়ে ব্যবসায়ীরা বাগিয়ে নিচ্ছেন বাড়তি অর্থ।
প্রশ্ন উঠেছে চলাচল নিষিদ্ধ এবং ফিটনেসহীন ওইসব যানবাহন কিভাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কুষ্টিয়ার সড়ক-মহাসড়ক! সম্প্রতি পুলিশের দেয়া মামলায় অনিয়মের অভিযোগ এনে কর্মসূচীও পালন করেছে মালিক-শ্রমিকদের একটি পক্ষ।
জনশ্রুতি আছে দালালের মাধ্যমে অবৈধ গাড়ির বৈধ কাগজ ও অপরিপক্ক চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্সের মাধ্যমে এসব গাড়ি অনেকসময় সড়কে ওঠে। কিছুক্ষেত্রে কাগজ পত্রও থাকে না৷ চলতি পথে প্রচলিত ম্যানেজ করে চলাচল করে তারা।
এ প্রসঙ্গে কথা বলা হয় সাম্প্রতিক আন্দোলনের সংগঠক, রেন্ট-এ কার ব্যবসায়ী আব্দুস সালামের সাথে, বিভিন্ন অনিয়মের মামলায় চালক ও ব্যবসায়ীরা ক্ষিপ্ত জানিয়ে তিনি বলেন, অনেকসময় আমাদের প্রাইভেটকার ভাড়া দেয়ার প্রয়োজন হয়। সে সময় নিষেধাজ্ঞা শিথিল রাখা দরকার। সরকারি কাজে ব্যবহারের ক্ষেত্রেও শহরের গাড়িগুলো বেশি নেয়া হয়। এটিও একটি সমস্যা জানিয়ে তিনি অভিযোগ তোলেন, হাইওয়ে পুলিশ দালাল নিয়োগ করে মাসোয়ারা নিতে চাচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে এই ব্যবসায়ী নেতা মন্তব্য করেন, ফিটনেসবিহীন গাড়ি বা গ্রাহক সেবা দিতে ব্যর্থ আছে এমন গাড়ি দিয়ে ব্যবসা চালানো উচিত না। সকল সেবা ঠিক থাকা উচিত।
এ সময় তিনি বলেন, জেলার মধ্যে ভেড়ামারা ও দৌলতপুর উপজেলায় ফিটনেসহীন গাড়ির সংখ্যা বেশি। দৌরাত্ম বেশি।
হাইওয়ে পুলিশের ওসি ইদ্রিস আলী তাদের বিরুদ্ধে আনা অনিয়মের সকল অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ফিটনেসহীন গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়েই এই দুরবস্থা। কড়া সিন্ডিকেট গাড়ি প্রতি ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকার বিনিময়ে রোডে চালানো মাসিক চুক্তিভিত্তিতে। তারা বিভিন্ন সময় সুপারিশ করে ছাড়িয়ে নিতো।
তবে, এখন এসব হচ্ছে না বলে তিনি দাবি করেন। ওসি ইদ্রিস আলী অবাক ভঙ্গিতে আরও বলেন, পুলিশের নাম ধরে পাবলিক টাকা নিবে! তিনি আরও দাবি করেন, তার এলাকায় ৭০ থেকে ৮০ টা অবৈধ শ্যালো ইঞ্জিন নিয়মিত চলে। ব্যাটারি চালিত গাড়িগুলো শুধুমাত্র পৌর এলাকায় চলে মানুষের চলাচলের সুবিধার্থে।
এছাড়া বাইরে থেকে আসা গাড়িগুলো থেকে প্রতিদিনই অন্তত ১৫টা করে মামলা হচ্ছে বিভিন্ন অনিয়ম অব্যবস্থাপনার জন্য। গেল মাসে মোট মামলা ৪৫৭ টা দেয়া হয়েছে। জেলায় চলা এ সমস্ত অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ গাড়ি নানা কৌশলে সড়কে চলাচল করছে বলেও জানান এই সরকারি কর্মকর্তা।
প্রকৃতপক্ষে জেলা জুড়ে শ্যালো ইঞ্জিন চালিত বিভিন্ন নামের অন্তত ৬-৭ হাজার গাড়ির দৌরাত্ম এখন সাধারণের কাছে ভয়ানক রূপ, এমনটাই মন্তব্য জেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষের।
বিভিন্ন উপজেলায় পুলিশ, ইউএনও এবং এসিল্যান্ডের নেতৃত্বে চলা অভিযানে এসব গাড়ি কিছুটা ভোগান্তিতে পড়লেও; ঝুকিপূর্ণ এসব গাড়ির ব্যবসায়ী ও চালক সমাজে এখনও মজবুত হয়নি বলে মন্তব্য সচেতন মহলের। তাদের অনেকেই মনে করছেন সড়ককে ঝুকিপূর্ণ করা হচ্ছে এক শ্রেণির ব্যবসায়ীদের অধিক মুনাফার জন্য। কম খরচে অবৈধ গাড়ি দিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছেন তারা।
সরেজমিনে দেখা যায়, শ্যালো ইঞ্জিন চালিত গাড়িগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন মাঝারি ও বড়ধরনের বাণিজ্যিক কাজে। ফিটনেসহীন গণপরিবহন ও মাইক্রোবাসে সেবার দাম তুলে নিচ্ছে সর্বোচ্চটাই। উপজেলা ভিত্তিক বিভিন্ন সুদৃষ্টির সুবিধার্থে সড়ককে ভয়ানক করে তুলে রমরমা ব্যবসা চালাচ্ছে অচল মাইক্রোবাস, শ্যালো চালিত গাড়ি।
পুলিশ ও ব্যবসায়ীরা একে অপরকে দুষলেও জেলার সড়কগুলোতে অবৈধ গাড়ির বেপরোয়া ও অনিয়মের চলাফেরা এখনো দৃশ্যমান। যার পরিণতিতে বার্ষিক হতাহতের পরিমাণও দিনকে দিন মাত্রা ছাড়াচ্ছে।
নিরাপদ সড়কের প্রত্যাশায় দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি কুষ্টিয়াবাসীর। পাশাপাশি দ্রুত কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে রেহায় চাইছেন সংস্কারাধীন সড়কগুলোর বেদনা থেকেও।