কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিকর্ম তার রচিত কাব্য, উপন্যাস, ছোটোগল্প, নাট্য সাহিত্য, প্রবন্ধ, চিত্রকলা ও সঙ্গীতের মধ্যে ছড়িয়ে আছে। ১৮৮৩ থেকে ১৯৩৪ সালের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ মোট তেরোটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- চোখের বালি, গোরা, ঘরে বাইরে, চতুরঙ্গ, শেষের কবিতা, যোগাযোগ, চার অধ্যায় ইত্যাদি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ৭ মে ১৮৬১ জোড়াসাঁকোর ৬নং দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনের পারিবারিক বাসভবনে।
জোড়াসাঁকো ছিল সেযুগে “ব্ল্যাক টাউন” আবাসস্থল দক্ষিণ কলকাতা ছিল “হোয়াইট টাউন”) নামে পরিচিত উত্তর কলকাতার চিৎপুর রোডের (বর্তমান নাম রবীন্দ্র সরণি) নিকটে। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির আশেপাশের অঞ্চলগুলি সেই সময় ছিল দারির্দ্যপীড়িত অঞ্চল এবং শহরে কেন্দ্র।
রবীন্দ্রনাথের পিতার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মাতার নাম সারদা দেবী। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন- তার পিতামাতার চোদ্দো সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠতম। ছেলেবেলায় রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য পত্রিকা, সঙ্গীত ও নাট্যানুষ্ঠানের এক পরিবেশে প্রতিপালিত হন।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার ছিল সেযুগের বিদ্যোৎসাহী ও শিল্পোৎসাহী সমাজে এক বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা আরম্ভ হয় দাদা হেমেন্দ্রনাথের হাতে। ছেলেবেলায় রবীন্দ্রনাথ শারীরিকভাবে সুস্থ সবল ও বলবান ছিলেন। তিনি মাত্র আট বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ কাব্যরচনা শুরু করেন।
১৮৭৮ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে ব্যারিস্টার হওয়ার উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ পাড়ি দেন ইংল্যান্ডে। প্রথম দিকে তিনি ব্রাইটন ও হোভের মেদিনা ভিলায় ঠাকুর পরিবারের একটি বাড়িতে অবস্থান করেন। সেখানে তিনি একটি স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন যদিও দাবি করা হয় যে, তিনি ব্রাইটন কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন, কিন্তু উক্ত কলেজের রেজিস্টারে তার নাম পাওয়া যায় না।
১৮৯০ সালে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে পারিবারিক জমিদারির তত্ত্বাবধান শুরু করেন। বর্তমানে এই অঞ্চলটি বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার অন্তর্গত। ১৮৯৮ সালে তার স্ত্রী মৃণালিনী দেবী ও সন্তানেরাও চলে আসেন শিলাইদহে। “জমিদার বাবু” নামে পরিচিত রবীন্দ্রনাথ এই সময় পারিবারিক বিলাসবহুল ঢাকাই বজরা পদ্মায় চড়ে সমগ্র জমিদারি তদারকি করে বেড়ান।
প্রজাবর্গের মধ্যে খাজনা আদায় ও তাদের আশীর্বাদ প্রার্থনা করে তাদের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করেন রবীন্দ্রনাথ। এই সৌজন্যে গ্রামবাসীরাও তার সম্মানে ভোজ সভার আয়োজন করতেন। এই দশকটিতে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন বহু গ্রন্থ এবং বাংলা সাহিত্যে প্রবর্তন করেন এক নতুন ধারার: ছোটোগল্প।
১৮৯১ সাল থেকে ১৯০১ সালের মধ্যে তিনি ঊনষাটটি ছোটোগল্প লিখেছিলেন। এই সব গল্পের উপাদান তিনি সংগ্রহ করেছিলেন সাধারণ বাঙালির জীবনের নানা আবেগ থেকে। সোনার তরী (১৮৯৪), চিত্রা (১৮৯৬) ও কথা ও কাহিনী কাব্যগ্রন্থগুলি এই সময়েরই রচনা। এছাড়াও একাধিক উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধও রচনা করেছিলেন এই সময়। উল্লেখ-যোগ্য পুরস্কার নোবেল পুরস্কার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার (১৯১৩) পান।
রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন সুস্বাস্থ্য ভোগ করলেও জীবনের শেষ চার বছর দীর্ঘস্থায়ী পীড়ায় কষ্ট পেয়েছিলেন। তার মূল সমস্যা ছিল অর্শ। এই চার বছরে দুবার দীর্ঘসময় অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী থাকতে হয় তাকে।
১৯৩৭ সালে একবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন কবি, এই সময় কোমায় চলে গিয়ে মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করেন অত্যন্ত কাছ থেকে। ১৯৪০ সালের শেষ দিকে আবার একই ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি এবার আর সেরে ওঠেননি। এই সময়কালের মধ্যেই জীবনের শ্রেষ্ঠ কিছু কবিতা রচনা করেন রবীন্দ্রনাথ। এই কবিতাগুলির মধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে মৃত্যুকে ঘিরে লেখা রবীন্দ্রনাথের কিছু অবিস্মরণীয় পঙক্তিমালা।
দীর্ঘ রোগভোগের পর, শল্য চিকিৎসার জটিলতার কারণে, ১৯৪১ সালের ৭ অগাস্ট (২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) ৮০ বয়সে কলকাতার জোড়াসাঁকোয় অবস্থিত বাসভবনের প্রয়াত হন রবীন্দ্রনাথ। উল্লেখ্য, জোড়াসাঁকোর এই বাড়িতেই কবির জন্ম ও বেড়ে ওঠা। আজও বাংলা ভাষী জগতে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুবার্ষিকী পরম শ্রদ্ধা ও ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে পালিত হয়ে থাকে।