শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:২৪ অপরাহ্ন

ওসমানপুর যেন খোকসার ব্রাহ্মণবাড়িয়া!

নিজস্ব প্রতিবেদক / ১৬৫২ বার নিউজটি পড়া হয়েছে
আপডেট টাইম: শনিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২১, ১১:৪৪ পূর্বাহ্ন

নানা ঘটনায় সারা বছরই আলোচনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা। ঠুনকো ব্যাপার নিয়ে আলোচিত এই জেলার ভূত ভর করেছে কুষ্টিয়ার খোকসার ওসমানপুর গ্রামে। আধিপত্য বিস্তার, জমি-জমাকেন্দ্রীক দ্বন্দ্ব কিংবা নামাজ পড়া নিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগেই থাকে শান্তির জনপদ খোকসার এই গ্রামটিতে। তবে প্রশাসনের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ- এমন অভিযোগও করছেন কেউ কেউ। সর্বশেষ গোলাগুলি আর লুটতরাজের ঘটনায় পুলিশকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন ক্ষতিগ্রস্তরা।

সবশেষ ঘটনাটি ঘটেছে বুধবার (১০ নভেম্বর) রাত এগারোটা। খোকসায় নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার রাতেই আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে ঘুমন্ত গ্রামবাসীর উপর সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে কমপক্ষে ২০টি বসত বাড়ী -দোকান ভাংচুর ও লুটতরাজ করেছে।

ওসমানপুর ইউনিয়নের কলপাড়া, কাজীপাড়া ও ক্যানেল পাড়ায় এ হামলা চালায় সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। এ সময় সন্ত্রাসীরা কমপক্ষে প্রায় ৩০ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। হামলায় আহত হয়েছেন অন্তত ১৫ নারী-পুরুষ।

প্রত্যক্ষদর্শীদের চোখে সেদিনের ঘটনা-

রাত সাড়ে ১১ টার দিকে সন্ত্রাসীরা কাজী পাড়ার জিকে ব্রিজের উপর কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ি আতঙ্ক সৃষ্টি করে। পরে ৫০-৬০ জন স্বসস্ত্র সন্ত্রাসী স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বর জহিরুল ইসলামের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর করে। রাত ২ টা পর্যন্ত প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে জহুরুল মেম্বরের সমর্থক হাফিজুল, সামছদ্দিন, বাটু, আফতাব নাসির মতিন, আজাদ, মহন, সোহরাবের বাড়িসহ কমপক্ষে ২০টি বাড়ি– দোকান ভাঙচুর করে। এসব বাড়িতে থেকে প্রায় ১৫ লাখ টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায় হামলাকারীরা।

গভীর রাতে হামলার সময় সন্ত্রাসীরা বৃদ্ধা হাসিয়া খাতুনের গলায় অস্ত্র ধরে আলমারীর চাবি নেবার চেষ্টা করে। এসময় তার দুই মেয়ে সন্ত্রাসীদের পায়ে চেয়ে ধরে কান্নাকাটি করে। তাতেও রক্ষা পায়নি তার বাড়ি। ভাংচুর ও লুট হয়েছে।

কাজীর ব্রিজ এলাকার পানি উন্নয়ন বোডের জিকে খালের সরকারী জমিতে বসবাস করেন সমিরন ও রেশমা। তাদেও বাড়িও রক্ষা পায়নি ভাঙচুর করা হয়েছে। তাদেও প্রতিবেশির ঘর থেকে গরু লুট করে নিয়ে গেছে সন্ত্রাসীরা। তারা জানান সন্ত্রাসীরা প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে হামলা চালায়। তারা আগের থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল। তাদের দাবি করেন, হামলাকারীরা তার প্রতিবেশি আফতাব শেখের একটি গরু, বাইসাইকেল লুট করে নিয়ে গেছে।

হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত জহুরুল মেম্বর জানান, ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার রাতে হামলা করবে বলে প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা আগেই জানিয়ে রেখেছিল। পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে কয়েকটি সন্ত্রাসীবাহিনী এক হয়ে গ্রামের ঘুমন্ত মানুষের উপর হামলা চালিয়েছে। সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা তিন ঘণ্টা ধরে অসংখ্য গুলি চালিয়েছে। লুটপাট করেছে প্রতিটি বাড়িতে। হামলার শুরু থেকে তিনি থানা পুলিশকে একাধিকবার ফোন করেছেন। কিন্তু প্রশাসন এগিয়ে না আসায় তার লোকজন বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে।

এদিকে, ওসমানপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান বাবলু জানান, রাতে হামলার বিষয়ে পুলিশকে তিনিও ফোন করেন। কিন্তু কোন প্রতিকার পাননি। ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের জন্য সন্ত্রাসীরা ঘুমন্ত মানুষের উপর হামলা করেছে।

হামলার পরে গ্রামের অবস্থা

হামলার পরদিন বৃহস্পতিবার সকালে কলপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, যাদের ঘর ভাঙচুর করা হয়েছে তারা অধিকাংশই দরিদ্র পরিবার। আতঙ্কে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা পালিয়ে গেছে। মহিলা ও শিশুরা রয়েছে আতঙ্কে। এছাড়াও আগ্নেয়াস্ত্রের খোসাও পাওয়া গেছে। প্রায় দুইঘণ্টা ধরে সন্ত্রাসীরা তাণ্ডব চালালেও কোনো পুলিশ এলাকায় আসেনি।

কী বলছেন ক্ষতিগ্রস্তরা

হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত এক পরিবার বলছেন, হামলার সময় প্রাণ বাঁচাতে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে পালিয়ে যান তারা। পরে বাড়ি ফিরে এসে দেখেন সকল জিনিস ভাঙচুর করে নগদ ৭০ হাজার টাকা নিয়ে গেছে সন্ত্রাসীরা। এমনকি সরকারের বরাদ্দ দেয়া তার একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের বাড়িটিও ভেঙেছে।

শাকেরা বেগম (৭৫) বলেন, সন্ত্রাসীরা ঘরের সব আসবাবপত্র ভাঙচুর ও লণ্ডভণ্ড করে। এর পর মেয়ের বিয়ে দেয়ার জন্য ৩ ভরি গহনা ও নগদ তিন লক্ষ টাকা সঞ্চয় করে রাখি সন্ত্রাসীরা তা নিয়ে যায়

খোকন সেখের স্ত্রী আলেয়া খাতুন বলেন, তার স্বামী বাড়িতে না থাকায় রাতে সন্তানসহ ঘুমন্ত অবস্থায় একদল সন্ত্রাসী বাড়িতে আক্রমণ চালিয়ে বাড়ি ঘরে লুটপাট চালায়। প্রাণের ভয়ে আমার সন্তানকে নিয়ে পাশের বাড়িতে চলে যায়।

হামলাকারীরা কারা আর কার লোক?

ভুক্তভোগী পরিবার ও এলাকাবাসীর অভিযোগ- আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ওসমানপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ওহিদুল ইসলাম ডাবলু ও সাবেক ইউপি মেম্বর ওয়াজেদের আদেশে সামিরুল, পাপ্পু, হেলাল, ময়েনসহ প্রায় অর্ধশতাধিক মাস্তান দেশিয় ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে তাদের উপর রাত ১১ টার দিকে হামলা চালায়।

এ বিষয়ে মাজেদ বিশ্বাস বলেন, ডাবলু চেয়ারম্যানের আদেশে ওয়াজেদ মেম্বারের নেতৃত্বে রাতের আঁধারে আমাদের বাড়ি ঘরে হামলা চালায়। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই।এবিষয়ে ওই এলাকার বর্তমান মেম্বর জহুরুল ইসলাম বলেন, আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসী বাহিনী আমার বাড়িসহ প্রায় ২০ জন সমর্থকের বাড়িতে হামলা ও লুটপাট করেন।

কী বলছেন অভিযুক্তরা

এ বিষয়ে অভিযুক্ত সাবেক মেম্বর ওয়াজেদ আলী বলেন, ১৫ বছর আগে মেম্বার ছিলাম। এবার আবার দাঁড়াবো। আমি বিএনপি সমর্থন করি। দুইমাস আগে জহুরুল মেম্বারের লোকজন আমার বাড়িতে হামলা চালিয়েছিল। ওই রাতে গুলির শব্দ শুনেছি। আমি ঘটনার সাথে জড়িত নয়। আমার ছেলে পাপ্পু হয়তো ছিল।

তবে ওসমানপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ওহিদুল ইসলাম ডাবলু বলেন, আমি পাঁচ মাস ঢাকায় আছি। আসন্ন নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী। জহুরুল মেম্বর নিজে নিজে এলাকায় ভাংচুর করে আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।

পুলিশের ভূমিকা কী ছিল?

গোলাগুলির ঘটনা ঘটলেও পুলিশ সদস্যরা পরদিন সকাল সাড়ে আটটায় ঘটনাস্থলে যান। ঘটনার রাতে খোকসা থানায় ডিউটি অফিসার ছিলেন উপপরিদর্শক (এসআই) রাজিব রায়হান। তিনি বলেন, রাতে তিনি ছাড়া থানায় শুধু একজন এসআই ও একজন এএসআই ছিলেন। ওসিসহ সব সদস্য মিরপুর ও ভেড়ামারায় নির্বাচনি ডিউটিতে চলে যান। রাতে ওসমানপুরের খবর পাওয়ার পর তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ওই এলাকার বিট অফিসারকে অবহিত করেন।

তবে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে খোকসা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দ আশিকুর রহমান বলেন, তিনি নির্বাচনি দায়িত্ব পালনে খোকসার বাইরে ছিলেন। হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ইউপি সদস্যকে অভিযোগ দিতে বলা হয়েছে। তিনি ফিরে কঠোর ব্যবস্থা নেবেন।

তবে তিনি সরাসরি একটি পক্ষে টেনে কথা বলেন। তিনি বলেন, জহুরুল মেম্বারের লোকজন প্রতিপক্ষের এক সমর্থকের লোককে মারধর করেন। এরপর রাতে ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া নির্বাচনি তফসিলের পর আরও বিরোধ বেড়ে যায়।


আপনার মতামত লিখুন :

Comments are closed.

এ জাতীয় আরো খবর...
এক ক্লিকে বিভাগের খবর